Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি -রঙ্গনা পাল , পর্ব-২


         


           কদম গাছটা থেকে টোপা টোপা জলের সামান্য আঘাতেই ছন্দপতন হলো  রাজন্যা-প্রণয়ের বিহ্বলতার। ওই টোপা টোপা জল ক্ষণিকের মধ্যেই রীতিমতো জলের ধারা হয়ে ক্রমাগত এমন দ্রুত গতিতে নামতে থাকলো যে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা দু'জনের কারো পক্ষেই সম্ভব হলো না। ভারি অবাক ব্যাপার দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকালেও কারো মুখে একটা কথাও সরল না। মনের ইথারে না জানি কতো কথার খই ছড়িয়ে আছে, শুধু বলা হলো না, নীরবে যে যার নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো। প্রণয়ের সাথে আজ যেটুকু মুহূর্ত কাটিয়েছে রাজন্যা, যদি আর কখনো প্রণয়ের সাথে দেখা না হয়, যদি আজকের মতোই কোন কথা না হয়, যদি ঘটে যাওয়া ঘটনাটা প্রণয় মনে রাখতে না চায় অথবা যোগাযোগ করা বা রাখার ইচ্ছে না রাখে, তাতেও কোন আপত্তি থাকবে না। কারণ সে জানে তার ভাগ্যের চালে বৃহৎ ফুটোটার কথা।

       এই বৃষ্টিমুখর দিনটায় বাড়িতে সে একাই ছিলো, তাই সটান বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, নিজের মনের ডাকে সাড়া দিতে পেরেছিলো। রাজন্যার মা বাবা, ভাই বোনকে নিয়ে কাকুর ছেলের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ-এ পাশের গ্রামে গিয়েছিলো। বাড়িটা দেখাশোনার জন্য রেখে গিয়েছিল রাজন্যাকে। তাছাড়া ঘরের বাসি কাজ থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় বাড়তি কাজ এবং এলোমেলো করে ছেড়ে রাখা জামাকাপড় ইত্যাদি গুছিয়ে রাখার দায়িত্বও ছিলো তার উপর। বাড়িতে ঢোকার মুখে চেঁচামেচি শুনে ভেতরে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা চালায় রাজন্যা। ওকে দেখেই তো ওর মা বাড়ি মাথায় করে‌। সে কী এমন করে ফেললো? কেন এই আক্রমণ? কারণ জিজ্ঞেস করতেই মা'য়ের চিলচিৎকার! 'আধবুড়ি মেয়ের হুঁশ দেখো, জানলা খোলা রেখে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গানের জলসা করতে গেছেন।" (বৃষ্টিতে কখনো কখনো গাইতে দেখেছে মা, এখান থেকেই আন্দাজ করেছে, বাড়িতে নেই যেহেতু তাই ভিজে ভিজে গান গেয়ে বেড়িয়েছে।)

তাই তো! প্রণয়কে দেখে এমনভাবে বেরিয়ে এসেছিলো, সদর দরজা বন্ধ করলেও যে দক্ষিণের জানালাটার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলো সেটা তো বন্ধ করা হয়নি। অপরাধ এতো মাত্রা ছাড়িয়েছে, ভিজে জামা পাল্টানোর জন্য ভেতরে ঢোকার অনুমতিটুকু পাচ্ছে না। আরো কিছু কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হজম করতে হবে, বেশ বুঝেছে। খাওয়ার তো বারোটা বেজে গেলো।খাবার আনার কথা ছিলো, এখন খিদেও পাচ্ছে কিন্তু কোন উপায় নেই। এমন কত দিন সামান্য কারণেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, আজ তো গুরুতর অপরাধ হয়ে গেছে। হাঁচি শুরু হয়ে গেলো। নাহ্! তাও পাষাণী মায়ের মন গললো না। কোন্ ধাতব পাতে গড়া ঈশ্বর জানেন।


       সন্ধে নেমেছে, ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পাশের বাড়ির বাচ্চাগুলোর পড়ার আওয়াজ আসছে। একটু পরে তার ভাই বোনও পড়তে বসবে। রাজন্যাকে হয়তো এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ভিজে জামা গায়ের মধ্যেই শুকোচ্ছে। সংসার নাকি মায়ায় ঘেরা, ভালোবাসায় মোড়া। রাজন্যা তো তার মায়েরই মেয়ে, তাহলে কেন এতো অবিচার? তার দুঃখ কষ্টগুলো কেন তার মা বোঝে না? কেন ভাই-বোনের জন্য ভালোবাসা তার জন্য ঘৃণা, তাচ্ছিল্য? জীবনের ষোলটি বছর কেটে গেলো অবহেলায়। বাবার চোখে মাঝে মাঝে তার জন্য করুণা থাকলেও না কোন দায়, না কোন দায়িত্বের মধ্যে পড়েছেন বলে মনে পড়ে না। এতোটা নীরবতা থাকতে পারে বাবার মধ্যে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কেউ বুঝবে না রাজন্যার ব্যথা। সন্ধে গড়িয়ে রাত রাত হয়ে গেছে। বৃষ্টি থামলেও বর্ষালি গন্ধটা ঘরময় ছড়িয়ে আছে। হাত পা, শরীরটা যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে রাজন্যার। খিদে মরে গেছে। জলতেষ্টাও নেই। রাত্রে এ বাড়িতে খাবার বানানো হয়নি, যতটা খাবার কাকার বাড়ি থেকে এসেছিলো, ভাগাভাগি করে খেয়েছে সবাই। এঁটো বাসনগুলো কাল সকালে পরিস্কার করতে হবে রাজন্যাকেই।


       মাঝরাতে পায়ে পায়ে স্টোর রুমে ঢুকলো রাজন্যা। এ বাড়ির এটাই সবচেয়ে ছোট ঘর। জিনিসপত্র ডাঁই করে রাখা। এরই মাঝে একটা ছোট্ট টেবিলে রাখা আছে রাজন্যার বইপত্র। একটা একজনের শোবার মতো তক্তা পাতা আছে। তার তলাতেও জিনিসপত্র ঠাসা‌। এই ঘরটাই বরাদ্দ রাজন্যার জন্য। যদিও পরনের জামা শুকিয়ে গেছিল অনেকক্ষণ আগেই তবু স্বস্তি পেতে নাইটিটা গলিয়ে এবার তক্তাটায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো রাজন্যা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে খিল ধরে গেছে। চোখ বন্ধ করতেই জোর করে চেপে রাখা সেই পড়ন্ত বিকেলের  সুখানুভূতি ফিরে পেলো। সাংসারিক অবিচার অনাচারের গণ্ডি পেরিয়ে, যাবতীয় ব্যথা অবসাদ ভুলে, সে পাড়ি দিলো অচিনপুরে; যেখানে রয়েছে তার ভালোবাসার রাজমহল। যেখানে প্রণয়ের বিস্তৃত বাহু  সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে তার শরীরটাকে। নাহ্! এখানে কষ্ট নেই, বিষাদ নেই আছে শুধু পরিতৃপ্তি। অবচেতনে রাজন্যা ডুবে যাচ্ছে একবুক ভালোবাসার গঙ্গাজলে। আহ্! দুটো হাত মুছিয়ে দিচ্ছে তার চোখের জল, সারা শরীরে লাগিয়ে দিচ্ছে ব্যথার মলম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ