ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি
পর্ব- ১
"মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে..."
ঘন কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে গান ধরেছে রাজন্যা। গলায় সুর ঢেলে দিয়েছেন ঈশ্বর, হাজার অপ্রাপ্তির মধ্যে এই একটি মাত্র প্রাপ্তি তার হৃদয়ের সমস্ত বেদনাকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। আষাঢ়ে মেঘ জমেছে তার মনেও, তবে এ মেঘে বৃষ্টি হয় না, শুধুই জমাট বাঁধে। এক এক সময় মনের মেঘ থেকে ঝরা বিগলিত ধারায় খুব ভিজতে ইচ্ছে করে। এই পর্যন্তই! কিন্তু ঈশ্বর বিরূপ। আসলে তার নামকরণে মা কোনরকম কোন কার্পণ্য না করলেও, বাকি কোন কিছুই তার বরাতে জোটেনি।
বংশের প্রথম সন্তান মেয়ে বলে, জন্মাবার পর থেকেই সে পেয়েছে অনাদর, অবহেলা। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে এসেছে; শুধু মেয়ে না, কালো মেয়ে বলে তার গর্ভধারিণী কীভাবে তাকে তিল তিল করে পরিস্থিতির যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে এসেছে। অ আ ক খ শেখার সাথে সাথেই শিখতে হয়েছে ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা, ঘর মোছা সহ আরো অনেক সাংসারিক কাজ। 'মা' কথা বলতে শেখার প্রথম উচ্চারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে সুমিষ্ট শব্দ, সন্তানের কাছে 'মা' পবিত্র ওম হলেও রাজন্যার কাছে 'মা' বিভীষিকাময় একটি শব্দ মাত্র। তারপর ভাই জন্মাবার পর ভাইকে নিয়ে চরম আদিখ্যেতা মা'য়ের প্রতি অবশিষ্ট ভক্তিটুকুর অবসান ঘটিয়েছিল নিঃশব্দে। বছর দুয়েকের ব্যবধানে রাজন্যার একটি বোন এলো ঘর আলো করে। মেরুদণ্ড সোজা হবার পর থেকেই রাজন্যাকে এই বোনের ফাইফরমাস সামলাতে হয়েছে তার মায়ের আদেশে।
অবশ্য রাজন্যা যতটা তার মায়ের মেয়ে, তার চেয়েও বেশি প্রকৃতি কন্যা। পারিবারিক চাপ সামলেও সে ভালোবেসেছে কুমুদ কহ্লার কদমকে, বর্ষার মেঘকে, গ্রীষ্মের উত্তাপকে, শরতের শিউলিকে, হেমন্তের শিশিরকে, বসন্তের হাওয়াকে আর তার স্কুলের বান্ধবীর মামাতো দাদা প্রণয়কে। তখন রাজন্যা নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো। ঠিক একবছর আগে এমনই এক আষাঢ়ে প্রথম দেখা প্রণয়ের সাথে। পরিচয়কালে মুখ টিপে হেসেছিলো কেবল। সেই হাসিটা আজ একবছর পরেও তেমনি দৃষ্টিনন্দন হয়ে আছে রাজন্যার হৃদয়ের পানপাত্রে। এর মাঝে দু'একবার কথা হয়নি এমনটা নয়, বলা ভালো ঘনিষ্ঠতা হয়নি। হাসি ছাড়াও রাজন্যা লক্ষ্য করেছে কথা বলার জন্য মুখ খুললেই প্রণয়ের দাঁতের সারিতে শব্দগুলো সুর তোলে, ঠোঁটদুটো সুন্দর ভাবে সঙ্গত দেয়। তার মতো কালো না হলেও প্রণয়ের শ্যামল বরন বেশ উজ্জ্বল। সে মিষ্টভাষী এবং শান্ত। ভালোলাগা এবং ভালোবাসার জন্য এই বা কম কিসের!
ইস্!! জলের ঝাপটায় রাজন্যার বামদিকটা ভিজে গেছে একেবারে। এতটাই ভাবনার তরঙ্গে ভাসছিলো, যে ঠিক সুযোগ বুঝে দক্ষিণের জানালাটা ভিজিয়ে দিয়েছে তাকে। তা হোক, তবু এই জানলার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে তার ইচ্ছেমতো যত্র তত্র ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। বৃষ্টি কমেছে, আকাশটাও ফর্সা হয়েছে খানিক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ওই কে যেন ছাতা হাতে ধীর পদক্ষেপে সামনের কদমতলা দিয়ে এগোচ্ছে, প্রণয় না? হ্যাঁ তাই তো। দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রণয়ের পিছু নিলো রাজন্যা। ধরেও ফেললো, এই প্রথম সে কোন পুরুষের হাত ধরে টান মেরেছে। থেমে গেছে প্রণয়, আকস্মিক এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত না থাকলেও খারাপ লাগছে না। আবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অগত্যা রাস্তার এই কদম গাছটার নীচেই দাঁড়িয়ে পড়লো দুজনে। রাস্তায় কোন লোক নেই, হয়তো বর্ষারানির কৃপায়! বর্ষার প্রথম বৃষ্টিটা প্রত্যেকের কাছেই অভিনন্দিত। রাজন্যা হাত ছাড়েনি, আবেশের মেঘমল্লার তার কণ্ঠে-
"আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না..
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়........"
কণ্ঠের যাদুতে প্রণয়ের ভেতরের বন্ধ দ্বার খুলে যাচ্ছে, একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে চাওয়া পাওয়ার অববাহিকায়, অদ্ভুত ভালোলাগায় জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে রাজন্যাকে, এতদিন পর্যন্ত তার পিসতুতো বোনের বান্ধবীকে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো মনে হলেও, আজ এই সাধারণ মেয়ে ষোড়শী তন্বী হয়ে তার শিরায় শিরায় উন্মাদনার আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, শরীরটা উন্মুখ হয়ে আছে একবার নিবিড়ভাবে কাছে পাওয়ার জন্য, ঠোঁট দুটোও আন্দোলন করছে আরো দুটো ঠোঁটে মিশবে বলে। এই শান্ত বারিধারা প্রণয়ের শরীরটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। এই মুহূর্তে রাজন্যাই কেবল শান্ত দিঘির মতো, এবার প্রণয় তাতে অবগাহন করবে নাকি খোলামকুচি ছুড়ে ছিনিমিনি খেলবে সেই জানে।
রাজন্যা গান শেষ করে অবাক বিস্ময়ে প্রণয়ের চোখে চোখ রাখলো। এই মুহূর্তটা তার কাছে ভীষণ দামি, জীবনে এই প্রথম নিজেকে ভালোলাগছে তার, মনে মনে লতানো গাছের মতো জড়িয়ে ধরেছে প্রণয়কে, হাত ছেড়ে এবার প্রণয়ের এতটা কাছে এলো যে প্রণয়ের গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে, কিছু বলার জন্য ওষ্ঠাধর খুলতেই, প্রণয়ের ঠোঁটে চাপা পড়ে গেলো কথা। বাদল দিনের প্রথম কদমের মতোই প্রথম চুম্বনের মাদকতায় আছন্ন দুটি প্রাণ।
0 মন্তব্যসমূহ