Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি /রঙ্গনা পাল :পর্ব_১৭





ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি /রঙ্গনা পাল: পর্ব- ১৭


         মানুষ নিয়তি তাড়িত হয়ে ভালোমন্দের সীমা টপকে কখন পরিণতিকে সুনিশ্চিত করে সে নিজেই জানে না। ছল, প্রলোভনের বিভ্রান্তি তো আছেই। রাজন্যা অবিমৃষ্যকারী নয় তবু প্রণয়কে সে গ্রহণ করতে পারলো না। তার মনে হয়েছে বিপদের সময় যে পাশে দাঁড়িয়েছে তার ঋণ শোধ করা যায় না। বার বার স্বাধীনের মুখ ভেসে আসছে। দারুণ ভালোবাসা জমেছে বলে নয় বরং একে ভবিষ্যতে ভালো থাকার অলিখিত অঙ্গীকার বলা যেতে পারে। ট্রেনিং শেষ। এখন চাকরির জন্য অপেক্ষা। চাকরি পেলেই বাড়িতে জানিয়ে চারহাত এক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপাতত বাড়ি ফিরে সেই নরক যন্ত্রণায় সামিল হবে। বাড়ি ফেরার আগে স্মৃতিতে রয়ে গেলো তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ডের করুণ মুখগুলোর প্রতিচ্ছবি। এই কদিনে ওদের সাথে একটা নিবিড় ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়েছে। সবাই এককথায় তার সান্নিধ্যে ভীষণ খুশি ছিল যে। ওদের উপর বড় মায়া পড়ে গেছে, নিত্য নৈমিত্তিক ডিউটির মধ্যে থেকে কোনদিন বুঝতেই পারেনি দিনগুলো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে সরে সরে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি ডক্টর এবং ম্যাডামদের স্নেহ ভোলার নয়, বিশেষ করে ভোলার নয় ডঃ দিব্যাংশু দেশপান্ডের নম্রতা, আর তার বন্ধুপ্রবণ মনোভাবের পরিচয়। আসলে গুরুদেবের অমোঘ বাণী কী মিথ্যে হতে পারে! "ক্ষণকাল দেখি ব'লে/দেখি ভালোবেসে।"


        অনেকটা আশা সঞ্চয় করে এসেছিল প্রণয়। বাবা বেশ রক্ষণশীল, সে তা ভালোমতো জানে। প্রেমের মতো উদ্বায়ী চিন্তার ধারপাশ দিয়েও হাঁটেন না তিনি। তাঁর বড় মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল বলে আজও তাকে মেনে নেননি। কঠোরভাবে মেয়েকে বলে পাঠিয়েছিলেন 'এ ভিটেয় যেন কোনদিন তার ছায়া না পড়ে'। জামাই-এর আ্যক্সিডেন্ট-এর খবর পেয়েও নির্বিকার থেকেছেন। সবাইকে বলে বেড়ান তার একটিই সন্তান, সে প্রণয়‌। ছেলের বিয়ে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন আছে। তিনি মনে করেন বিয়ে মানে একটা সেতু বন্ধন, এর মধ্য দিয়েই ভালোবাসার পবিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিয়ের পর সংসারে প্রবেশ করা মাত্র সম্পর্কের ভিত মজবুত হয়। প্রণয় প্রথমটা ভুল বুঝে রাজন্যার থেকে সরে এসেছিল পরে বাবার প্রতি ভয়ে সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবেনি। অশান্ত মনকে শান্ত করেছে নিজের প্রচেষ্টায়। অসমাপ্ত ইচ্ছেগুলোকে এতদিন গুপ্ত খাঁচায় বন্দি করে রেখেছিল। ভিত মজবুত হবার পর বাবার স্বপ্নকে বাঁয়ে রেখে অতিরিক্ত সাহস সঞ্চয় করে রাজন্যার কাছে এসেছিল তার কিশোরপ্রেমকে মান্যতা দিতে। সেদিনের বৃষ্টিভেজা প্রথম চুম্বনের স্বাদ আজও তরতাজা। সামান্য ছোঁয়ার অনুরণন এখনও ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হয়; রাজন্যা কী করে সব ভুলে যেতে পারে? মানছে, অনেকটা সময় গলে গেছে তাদের দুজনের বিচ্ছেদের ইতিহাসে; তবু তাকে অন্ততঃ ভাবনার স্তরে রাখতে পারতো। সামান্য ভালো ব্যবহার তো করা যেতো! গন্তব্য এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে ভাবতে পারেনি, তাহলে কী রাজন্যাকে বুঝতে, তার মনের ভাষা পড়তে ভুল করে ফেলেছিল প্রণয়!


       প্রণয়কে ওভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে মন ভালো নেই রাজন্যার। এর মধ্যে আবার বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। এই বাড়ি যেন আর এক বিষাদের কারখানা! জানে না কখন মুক্তির আলো প্রবেশ করবে তার অভিশপ্ত আরশিতে। তবে এতদিন পর প্রণয় আবার তার জীবনে ফিরে আসতে পারে, এ তার কল্পনার বাইরে ছিলো। কেন এলো? কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল? অবশ্য প্রণয়ের কোন কথা সে শোনেনি ঠিক করে, বলার সুযোগও দেয়নি। দিয়েই বা কী লাভ! সে কী মনে করেছিলো? রাজন্যা এখন আর আগাছা নয়, তাকে না উপড়ে যত্ন করতে হবে? কিংবা সে বুঝি দম দেওয়া পুতুল, যখন খুশি এসে খানিকটা দম দিয়ে নিজের মতো খেলবে! আক্ষেপের কিছু  নেই, তবে এও ঠিক জীবন তার সাথে অহরহ ছিনিমিনি খেলে চলেছে। ভালো-খারাপ, উচিত -অনুচিতের বাইরে চলে এসেছে সে। জটিল আবর্তের মধ্যে পাক খেতে খেতে ক্লান্ত সে। বোধশক্তি কাজ করছে না মোটে।


        বাড়ি ফিরে এসে রাজন্যা আবারও চমকাল খানিকটা। মা কেমন হাসিমুখে বাড়িতে স্বাগত জানালো! স্টোর রুমের পরিবর্তে একটা রুমও পেল। শুধু তাই নয়, মা রীতিমতো মিষ্টি সুরে কথা বলছে। ভাই বোন কাছে এসে অনর্গল বকবক করছে। এ কি সত্যি? নাকি প্রহেলিকা? এও ছিল তার বরাতে!! কিন্তু কীভাবে!! দূর..... আর মাথা কাজ করছে না। মোটেই হালকাভাবে নিতে পারছে না, টেনশন কমছে না কিছুতেই। ঠাকুরঘরের পাশের ঘরটা ঠাকুমার ছিল। ঠাকুমা গত হওয়ায় পর মায়ের কাছে এই ঘরে থাকার আবদার করেও সুরাহা করতে পারেনি, আজ না চাইতেই পেয়ে গেলো?অতীতকে নিমেষে ভুলে গিয়ে, মায়ের থেকে পাওয়া অত্যাচারের দিনলিপির পাতা না উল্টে, হঠাৎ পাওয়া উপহারকে জড়িয়ে নিলো মালার মতো, সমস্ত অবসাদের বিসর্জন দিয়ে গেয়ে উঠলো....

"কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে—

        সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।

   ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে

 সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়....."


         রাজি এতো ভালো গাইতে পারে! মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলে। চির অবহেলার মধ্যেও এ যে গোবরে পদ্ম! রাজন্যার ভেতর থেকে একটা ভারি পাথর ধীরে ধীরে যেন ক্ষয়ে যেতে শুরু করলো। এদিকে গানের ঘোরে   সমস্ত ব্যথার অবসান হয়ে গেছে মনে হলো। এবার চমকের উত্তেজনা পেরিয়ে রুমে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই নজর পড়লো দক্ষিণের বন্ধ জানালাটার প্রতি। তাড়াতাড়ি গিয়ে জানলাটা হাট করে খুলে দিল,   চারপাশের প্রকৃতি হেসে উঠলো। মা তাড়াতাড়ি বলে উঠলে, "আহা! কী করছিস? রোদের ঝাঁঝ লাগবে তো। আগে স্নানটান সেরে  একটু জিরো, তারপর খেদেদেয়ে রোদ পড়লে খুলিস..." এই তো মায়ের স্বরূপ! ভালোমানুষী পট্টি সরে গিয়ে আ্যমনিয়ার গন্ধ বেরোচ্ছে। বাকিটাও জানা যাবে, খানিক ধৈর্য রেখে মনে মনে খানিক হেসে জানালাটা তখনকার মতো বন্ধ করে সদ্য পাওয়া আকাঙ্ক্ষিত রুমে এসে লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিক্ষেপ করলো রাজন্যা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ