ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি / রঙ্গনা পাল
নন্দিনী নাট্যমঞ্চে "সুধাময়ীর নৃত্যসুধায়" নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। মহড়া চলছে জোরকদমে। স্বাধীন অফিস কামাই দিয়ে রীতিমতো মজে আছে নাটকের মহড়ায়। জমিদার রুদ্রপ্রয়াগের চরিত্রে নিজেকে মেলে দিয়েছে পূর্ণভাবে। সুধাময়ীর চরিত্রে নামকরা নৃত্যপটিয়সী অভিনেত্রী রম্ভা অরোরা। এই প্রথম রম্ভার সাথে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে স্বাধীন। জান-প্রাণ দিয়ে অভিনয়ের উৎকৃষ্টতা প্রমাণের চেষ্টায় রত সে। মহড়ার একটা সিনে ছিলো সুধাময়ীর মাতাল জমিদার রুদ্রপ্রয়াগকে ধরে তুলে দেওয়া। বাস্তবে রুদ্রপ্রয়াগ জোর করে সুধাময়ীকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। রম্ভা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে-
-এটা তো নাটকে নেই।
-তোমার রূপ আমাকে পাগল করেছে সুধাময়ী, আমার প্রশস্ত বুকে-
-চুপ করুন, সুধাময়ী নই আমি রম্ভা অরোরা। তাছাড়া নাটকে সুধাময়ীর কাজ নৃত্য পরিবেশনের দ্বারা সকলের মন জয় করা।
-কেন খারাপ লেগেছে?
- আপনাকে নিপাট ভদ্রলোক মনে হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে আপনি অসভ্য, ইতর। নাট্যসংস্থা আপনার, প্রযোজক আপনি বলে কি অভিনেত্রীদের সম্মান নেই? সবাই তো দেখছি আপনার পেটুয়া, প্রম্পটার থেকে আরম্ভ করে কারো মুখে টু'শব্দ নেই
-দুঃখিত, না বুঝে আমি আমার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছি।
-ধন্যবাদ, ভবিষ্যতে সচেতন থাকলেই হবে।
'সুধাময়ীর নৃত্যসুধায়' নাটকটি রচনা করেছেন নাট্যকার বিমল সন্নীগ্রাহী। এই নাটকে সুধাময়ী একজন নর্তকী । সুধাময়ীর স্বামী চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন। সুটিং-এর সময় পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে কোমরের নিচের অংশ পুরোটাই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। মাথাতেও প্রচণ্ড আঘাত লাগে। চিকিৎসাতে তেমন উন্নতি না হওয়ায় অথর্ব হয়ে বাড়িতেই পড়ে আছে। অন্যদিকে অনন্যোপায় সুধাময়ী ছোটবয়স থেকে শিখে আসা নাচকেই পেশা হিসেবে নিতে বাধ্য হয়। সে অবশ্য ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতো একদিন নামকরা নর্তকী হবে। বিয়ে হবার পর নাচটাকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়, শ্বশুরবাড়ির চাপে। শ্বশুর শাশুড়ির একমাত্র পুত্রবধূকে একপ্রকার গৃহবন্দি-ই থাকতে হয়। পুত্র দুর্ঘটনার কবলে পড়লে রোজকার জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যে ভাটা পড়ে। স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সুধাময়ী প্রথমে নাচের অনুষ্ঠান শুরু করে। তারপর একদিন জমিদার রুদ্রপ্রয়াগবাবুর জমিদারের জলসায় নাচের আসরে চড়া পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নৃত্যপ্রদর্শন করতে এসে জমিদারের স্নেহের কাছে বাঁধা পড়ে যায়। এখন থেকে তার জলসাঘরে রোজ নাচতে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলে। এখানে এসে সে লক্ষ্য করে কাছের লোকেরা জমিদারকে মদ্যপান করিয়ে, ঠকিয়ে সমস্ত জমিদারি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে রায় নিরন্তর। রোজ মদ্যপ জমিদারকে ধরে ধরে শয়নকক্ষে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরে সুধাময়ী। জমিদারের সমস্ত ট্রাজিডি দূর করে, মদ্যপ জমিদারকে অত্যন্ত কৌশলে মদের নেশা কাটিয়ে, স্বজনশক্রর হাত থেকে রক্ষা করে দাপুটে জমিদার হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার অদম্য প্রয়াসে জয়ী হয় সুধাময়ী। পরিবর্তে জমিদার তার কন্যাসমা এই সুধাময়ীর নৃত্যসুধার খবর ছড়িয়ে দেন বিশ্বের দরবারে, আজন্মলালিত স্বপ্ন সাকার হওয়ার গৌরব নাটকটির মূল সুর। আর সুধাময়ীর অসাধারণ নৃত্যের যাদু নাটকটির সর্বাঙ্গে। রম্ভার অসাধারণ নাচের জন্যই হয়তো বিমলবাবু নাটকটি রচনা করেছেন। বর্তমানে রম্ভা বিমলবাবুর সহধর্মিণী রম্ভা অরোরা সন্নিগ্রাহী।
স্বাধীনের বন্ধু পরিমল সূত্রধর নামকরা সাহিত্যিক। স্বাধীন যেহেতু নাট্যপাগল তাই পরিমল-ই বিমলবাবুর এই নাটকটি মঞ্চস্থ করার কথা বলে। আর নাটকের নায়িকা রম্ভার সন্ধান এনে দেয়। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় বিনোদিনী হলে। রম্ভার মনকাড়া নাচ প্রথমবার দেখে অভিভূত পরিমল। স্বাধীনের কাছে পরিমল তাই নন্দিনী নাট্যমঞ্চে নাটকটি মঞ্চস্থ করার প্রস্তাব রেখেছিল। স্বাধীন নতুন ভাবে নাটকটি উপস্থাপন করতে চলেছে, জমিদার রুদ্রপ্রয়াগের চরিত্রে স্বাধীন স্বয়ং, আর সুধাময়ীর চরিত্রে রম্ভা। পরিমলের কথায় রম্ভা অভিনয়ে সম্মতি জানিয়েছে। নাটকটি মঞ্চস্থ হবে ৫-ই সেপ্টেম্বর। বেশি সময় হাতে নেই। রম্ভাকে চটিয়ে ফেলেছে স্বাধীন। ভয় পাচ্ছে যদি রম্ভা কোনভাবে নাটকের পার্ট ছেড়ে চলে যায়। আসলে এর আগেও সে বহুবার নাটকদলের বহু মেয়েদের নাটকের মঞ্চ ছাড়াও নিজের শয়নকক্ষে একান্ত আপন করে পেয়েছে। রম্ভাকেও তাদের সাথে এক করে ফেলে জড়িয়ে ধরে কেস খেয়ে গেছে নিজেনিজেই। এখন মা'র দারস্থ হয়ে ফোন করানো ছাড়া আর কোন উপায় দেখছে না স্বাধীন।
স্বাধীনের আচরণে রম্ভা প্রথমটা বিরক্ত হলেও কেমন যেন একটা বাড়তি টান অনুভব করছে। কী ছিল স্বাধীনের ছোঁয়ায়? লোকটার চোখে মুখে লাম্পট্য স্পষ্ট তবু কেন বিরক্তি ভাবটা কেটে গিয়ে ক্ষীণ আশার চাঁদ উঁকি দিচ্ছে মনের বারান্দায় ? কেন? লোকটার ছোঁয়ায় কী যে সুরের মূর্ছনা মনের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে রেশ কাটতেই চায় না। ফোনটা বাজছে... রিসিভ করতেই ওপারে অচেনা মহিলা কণ্ঠ...রম্ভা জানতে চায়-
-কে বলছেন?
-তুমি কি সুধা বলছো?
-না,আমি রম্ভা আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।
-আমি স্বাধীনের মা। সুধাময়ীর নৃত্যসুধা নাটকের জমিদার রুদ্রপ্রয়াগের মা বলছি..
-ওহ্ মাসীমা! হ্যাঁ বলুন
-তুমি রম্ভা হলেও আমার কাছে সুধা ছেলে তো তোমার নাচের প্রশংসায় দিন রাত এক করে ফেলছে.... খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়। একদিন বাড়িতে এসো..
-আবার বাড়িতে কেন? নাটক দেখতে আসবেন না?
-অবশ্যই আসব কিন্তু তার আগে তুমি এসো আমার বাড়িতে।
আচ্ছা আমার ওঁর সাথে কথা বলবো, রাখছি এখন পরে কথা হবে।
প্রত্যুত্তরের কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিলো রম্ভা।
-এরপর আগামী সপ্তাহে...

0 মন্তব্যসমূহ