ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল
আবার নাটকের মহড়ায় উপস্থিত হয়েছে রম্ভা, মহড়া চলছে জোরকদমে। স্বাধীন কোন বাড়তি কথা বলছে না, ছোঁয়া বাঁচিয়ে অভিনয় করে চলেছে। রম্ভা লক্ষ্য করে স্বাধীনের অভিনয় দক্ষতা প্রবল, এতো নিখুঁত তার অভিনয় মনে হচ্ছে সে যেন জীবনের শেষ বয়সে এসে এক নিষ্ঠুর চক্রান্তের শিকার হয়েছে, জীবন যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে কোনরকমে তার জলসাঘরের বাতি জ্বলছে টিমটিম করে। একমাত্র সুধাময়ীর নৃত্যের যাদুতে সে কোনরকমে প্রাণসুধা নিয়ে বেঁচে আছে। রুদ্রপ্রয়াগের নুন খেয়েছে সুধাময়ী, তাই তার জীবনকে সুরক্ষিত করতে তাকেই এগিয়ে আসতে হবে। যেভাবেই হোক তার অভিশপ্ত জীবন থেকে তাকে মুক্তি দিতে হবে। নাটকের রুদ্রপ্রয়াগকে সুধাময়ী থেকে কখন রম্ভা হয়ে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে টের পায়নি। আস্তে আস্তে স্বাধীনকে কাছে পাওয়া কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে। এই যে এখন স্বাধীন তার সাথে কথা বলছে না ঠিক করে, এটাও অস্বস্তিকর লাগছে তার কাছে।
স্বাধীনের সাথে আলাদা করে কথা বলার জন্য ভেতরটা বেশ ছটফট করছে। মহড়া শেষে বাড়ি ফেরার সময় রম্ভা স্বাধীনকে বলে -
-আমাকে বাড়ি অবধি ছেড়ে দিতে হবে
-আচ্ছা, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
-না, আপনি যাবেন
-কিন্তু...
-ওসব মিটে গেছে, এখন চলুন...
-আসলে আমার মা'কে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবার কথা আছে
-উনি সেদিন ফোন করলেন, গলা শুনে তো অসুস্থ মনে হলো না-
-মা আসলে নিজের অসুখের কথা ভুলে থাকতে চান। তিনি সবসময় হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল থাকতেই বেশি পছন্দ করেন।
- আপনি যান তাহলে
-ধন্যবাদ ম্যাডাম।
-আমি দুঃখিত, আমি জানতাম না আপনার মা অসুস্থ।
- না, না এতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই
-ঠিক আছে। আমি মাসিমাকে ফোন করে নেবো একবার।
- বেশ, সাবধানে যাবেন।
স্বাধীন পেরেছে, রম্ভার মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে। প্রথমে সাহসী হয়ে যে কাজ করতে পারেনি, আজ বিনয় দিয়ে সেই কাজ হাসিল করে নিতে পেরেছে। তবে রম্ভা আর পাঁচটা মেয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা বোধ যথেষ্ট বেশি, তাই সাবধানে এগোতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে পাখি খাঁচা ছাড়া হবে, তাই সুযোগ পেয়েও রম্ভার সাথে গেলো না স্বাধীন। মেয়ে দেখলে যার জিভ লকলকিয়ে ওঠে, সেই স্বাধীন হাতের শিকার ছেড়ে দেবে এতটা বোকা নয়। রম্ভার সাথে গেলে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারতো না, নাটকের মহড়া চলাকালীন নিজেকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কাউকে চোখে ধরেছে, অথচ তার স্বাধীনতা নিজের করে স্বাধীন নাম সার্থক করেনি এখনও তেমন নমুনা নেই স্বাধীনের চরিত্রে। দপ্ করে অগ্নিশিখার মতো রাজন্যার মুখখানি ভেসে উঠতেই মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তায় মনে মনে বলে- "তোকে যদি বিয়ে করে আমার দাসী না করেছি তো আমার নাম স্বাধীন নয়"। এখন কেবল নাটকটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা।
স্বাধীনের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো রম্ভার। মা'য়ের কতো খেয়াল রাখে সে! বর্তমানে অধিকাংশ সন্তান যেখানে তার বাবা-মা'র দেখাশোনা তো দূরে থাক নিজের স্বার্থের জন্য তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, সেখানে স্বাধীনকে আদর্শ ছেলে বলতে হয়। নিজে ভালো চাকরি করে, দেখতে সুপুরুষ আবার একটা নাটকের দলও খুলেছে। কল্পনার দুনিয়া থেকে সরে আসে ড্রাইভারের কথায়- দিদিমণি আপনার বাড়ি এসে গেছি"। "ওহ্! হ্যাঁ -" বলে নেমে পড়ে রম্ভা। কেমন ভাবের জগতে ঘোরাফেরা করছে সে আজকাল। আগে তো এমনটা ঘটেনি কখনো। এর আগেও অনেকবার নাচের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। এরকম কোন অভিজ্ঞতা হয়নি। যদিও একটা নাচের অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল নাট্যকার বিমল সন্নিগ্রাহীর সাথে এবং ঠিক প্রেম না হলেও বিয়েটা হয়েছিলো, বিমলের কাকাবাবুর মধ্যস্থতায়। এতটা অস্থিরতা হয়নি কখনো। নাকি ওই অনভিপ্রেত ঘটনাটা রয়েছে সবকিছুর মূলে?
স্বাধীনের বাবা স্বরাজবাবু স্বাধীনের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট নন। ছেলের বেলেল্লাপনার জন্য তিনি তার সহধর্মিণী সুপ্রভাকেই সর্বাংশে দায়ী করেন। আজকাল যেন সবটাই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য লাগলেও নিরুপায় তিনি। ফলতঃ ছেলের বেলেল্লাপনার মদতদাত্রীকে এখন তার স্ত্রী বলে পরিচয় দিতেও গ্লানি বোধ হয়। যেহেতু সুপ্রভা তার ব্যবসাপত্র দেখাশোনা করে, হিসেব রাখে আর টাকাপয়সার একটা মোটা অংশ তার কাছে গচ্ছিত থাকে, সুতরাং তার দাপটও বেশি। যেকোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সুপ্রভার সর্বাগ্রে। পরিবারের কর্তার কথা তার আমল না দিলেও চলে।স্বরাজবাবু শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিছু বললেই অশান্তি হয় তাই বেশিরভাগ সময় চুপ করেই থাকেন। তাছাড়া বহুবার শান্তভাবেই সুপ্রভাকে বুঝিয়ে দেখেছেন সে নিজেকে সংশোধন তো করেইনি উপরন্তু স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা বাড়িয়েছে। স্বাধীনের প্রতি সুপ্রভার অতিরিক্ত স্নেহ স্বাধীনকে বিগড়েছে। ধর্মভীরু এই মানুষটি ভাবেন একদিন এই পাপাচারের কারণেই পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসবে।
বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে আড্ডা জমিয়েছে স্বাধীন। রসিয়ে রসিয়ে বলছে আজকের গোবেচারা রম্ভার কথা। মা হঠাৎ বলেন-
-বিয়ের কথা ভেবেছিস কিছু?
-হ্যাঁ, মা বিয়ে আমি করবো রাজন্যাকেই।
-ওই কালো মেয়েটার সাথে থাকতে পারবি তো?
-আমার থাকায় কী যায় আসে!
-সে কী রে? ভেবে বল, সেইমতো কথা বলতে হবে তো-
-যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা সহজ মেয়ে সে নয়-
-হ্যাঁ, রে বিয়েতে রাজি হবে তো?
-অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন ট্রেনিং শেষ না হয়
-তুই বলেছিস, আমি দেখা করতে চেয়েছি?
-বলেছি তেমন সাড়া পাইনি। তবে, একটু সময় দিলে ঠিক পটিয়ে ফেলবো...
মায়ের কাছ থেকে ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো স্বাধীন। রম্ভা সরে গিয়ে এখন তার মানসপটে শুধুই রাজন্যার মুখ, তার উদ্ধত বুক...এই মেয়েকে পেতে গেলে বিয়ে করতে হবে, করবে বিয়ে তবু হার স্বীকার করবে না কিছুতেই। গাঁইয়া প্রণয় আর দাম্ভিক রাজন্যা এই দুটোকে আলাদা করতে হবে চিরতরে। তার অভিধানে পারি না বলে কোন শব্দের অস্তিত্ব নেই।
এরপর আগামী সপ্তাহে.....
0 মন্তব্যসমূহ