ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল
দুঃখের অমাবস্যা পেরিয়ে সুখের চাঁদ এলো রাজন্যার মনের উঠোন আলো করে। নিজের মা'র থেকে জন্মাবধি যে ভালোবাসা, স্নেহ পাওয়ার জন্মগত অধিকার ছিলো তা থেকে সে চিরবঞ্চিত হয়ে আছে অথচ স্বাধীনের মা কখন যেন নিজের মা'র অভাব পূরণ করে দিয়েছে। ওর মা'কে দেখার পর, সে জেনেছে মায়েরা কতটা স্নেহময়ী হন। আর কোন আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই, খেদ নেই তার। স্বাধীনকে সে আগাগোড়া ভুল বুঝে এসেছে। ভেবেছে স্বাধীনের চরিত্রে দোষ আছে, কই তার নিজের বাড়িতে প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত থাকলেও বিন্দুমাত্র সুযোগ নেওয়া বা কোনরকম ছোঁয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করলো না। তবে হ্যাঁ, ভালোবাসার দাসখত লিখে দিয়েছে। এতেই ভালোবাসার কাঙালিনী রাজন্যা স্বর্গের সিঁড়ি আবিষ্কার করে ফেলেছে। এখন শুধু ট্রেনিং শেষ হওয়ার অপেক্ষা। মোটামুটি ঠিক করে নিয়েছে চাকরি পাওয়ার পর স্বাধীনের সাথেই গাঁটছড়া বাঁধবে। চেষ্টা করবে তার পরিবারটাকে মানিয়ে নিয়ে সংসার করার। কতজন বা বিয়ের আগে প্রেমে পড়ে? বেশিরভাগটাই তো বাবামা'র ঠিক করা পাত্রের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেও বিয়ের পরই না হয় ভালোবাসার সেতু তৈরি করবে।
স্বাধীনের বাড়ি থেকে প্রায় অর্ধেক রাতে বাড়ি ফিরল রাজন্যা। স্বাধীন দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, যতক্ষণ না রাজন্যা বাড়ির ভেতর ঢোকে। রাজন্যার ভয় তো একটু ছিলই, যদি মা দরজা না খোলে! এমন তো হয়েছে অতীতে। কিন্তু না, ব্যঙ্গ কটূক্তি মিশ্রিত বাক্যবাণ নির্গত হলেও দরজাটা খুলে গেল। কোন কথা না বলে রাজন্যা দ্রুত পাশ কাটাতে গেলে মা ঠিক ধরে ফেলে কথার ফাঁদে- -এতো রাত পর্যন্ত কোন চুলোয় ছিলি ? -স্বাধীনের মা আটকে দিয়েছিল। -কেন রে? তোকে বাড়ির বউ করবে নাকি?এ কথাটার জন্য রাজন্যা মোটেও প্রস্তুত ছিল না, তবু নিঃসংকোচে উত্তর ছোট্ট অথচ দৃঢ় উওর দিল- -হ্যাঁ। -তা তোর আর কেউ জুটলো না বুঝি? -কেন বলো তো? -গোটা পাড়া জানে ওই ছোঁড়ার কীর্তিকলাপ .. - রাতদুপুরে কী সব বলো, তোমার মাথা ঠিক আছে তো? -আমার মাথা ঠিক আছে, তোরটা একবার দেখিয়ে নিস, যতসব ভীমরতিপনা..নষ্টামির আর জায়গা পাস না.. মা'র কথার কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বরাদ্দ স্টোর রুমে এসে ধপ করে বসে পড়ে পড়লো সে। এজন্য বাড়িতে আসার ইচ্ছে হয় না আজকাল। ফুরফুরে মনটা ফের ডুবে গেল বিষণ্ণতায়। রাজন্যা মাকে তো আজ নতুন করে চিনছে না, হতে পারে মা মিথ্যে বলছে অথবা বাজে কথা বলা স্বভাব বলেই হয়তো স্বাধীনের নামে গালমন্দ করছে। সে মোটেও এই মুহূর্তে বিয়ে করে ফেলছে না, তার জন্য অপেক্ষা থাকবে আরো বেশ কয়েক বছরের। আরও কাছ থেকে দেখবে তারপর তো সম্পর্ক জোড়ার পালা। তবে আজ নিজে চোখে খুব কাছ থেকে মানুষগুলোকে দেখে ক্ষণিকের জন্যও মনে হয়নি মানুষগুলো খারাপ। আগামীর কথা বলবে আগামী, এসমস্ত কান ভারি করা কথায় মন খারাপের কোন মানেই হয় না। পরিস্থিতি অনুযায়ী না হয় সিদ্ধান্ত নেবে। সকালেই ফিরে যেতে হবে মেডিকেল কলেজে, এবার কাজের চাপ আরো বাড়বে। অযথা দুশ্চিন্তা না করে লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। অবসাদ ভুলে একটা দিন একেবারেই অন্যরকম ভাবে কাটিয়েছে, তার কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
রেলগাড়ির স্টেশনের মতো এক একটা জায়গা অতিক্রম করে এবার থার্ড ইয়ারে রেড বেল্টে পড়লো রাজন্যা। দায়িত্ব কর্তব্য বেড়ে গেল চতুর্গুণ। আগের দায়িত্বের সাথে এবার পুরো ওয়ার্ড সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়লো। ওয়ার্ডের রোগীদের নিয়ে শুরু হলো ঘর গৃহস্থালি। এ এক নতুন জীবন, নতুন অভিজ্ঞতা। অনেক সিস্টারকে দেখেছে অসুস্থ মানুষদের সাথে পাষণ্ডের মতোই ব্যবহার করতে। সিনিয়রদের কিছু বলার এক্তিয়ার নেই, অতএব তখনকার মতো চুপ থেকেছে। এখন পুরো ওয়ার্ড স্বাধীনভাবে দেখাশোনা করতে পারবে ভেবে দারুণ আনন্দ হচ্ছে। রোগীদের নিয়মিত মেডিসিন, ইনজেকশন দেওয়া এখন তার রক্তে মিশে গেছে। স্নেহ, মায়া, মমতার সাথে ঠিকঠাক এগোচ্ছিল রাজন্যা খানিক উত্তেজনা বেড়ে গেল, যখন শুনলো তাকে ও.টিতে ডক্টরকে এসিস্ট করতে হবে। অজানা ভয় বাসা বাঁধলো মনে; সে পারবে তো? অবাক হবার আরো বাকি ছিল! সে যে ডঃ দিব্যাংশু দেশপান্ডের এসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজে নামছে...
-এরপর আগামী সপ্তাহে.....
0 মন্তব্যসমূহ