ভয়ানক চিন্তায় রয়েছে স্বাধীন। রাজন্যা মরবে তো? নাকি বেঁচে যাবে? হাসপাতালে না নিয়ে গেলেই পারতো। কেন যে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেল, তার নিজের কাছেই কোন উত্তর নেই। আর ওই ব্যাটা অনুপমটাও ভোরের আলো ভালো ফুটেছে কি ফোটেনি তাকে ঠিক চিনে ফেলেছে। আবার পিছন পিছন ধাওয়া করেছিল কিছুটা, ষাঁড়ের মত চিৎকার করে তার নাম ধরে ডেকেছিল, ভাগ্যিস সাড়া না দিয়ে কিছু না শোনার ভান করে চলে এসেছিল! ধরা পড়ে গেলে নানারকম এজাহার দিতে হতো। অনুপম তার বন্ধু না শত্রু বোঝে না। খালি বড় বড় জ্ঞানের ঝাড়ি মারে, অন্যদিকে রাজন্যাকে প্রশংসায় মুড়ে দেয়। এই কারণেই তাকে মোটেও সহ্য করতে পারে না স্বাধীন। সটান পালিয়ে এলো একমাত্র ভরসার আশ্রয় কামিনীর কাছে। ইচ্ছে ছিল দুজনে অন্য কোথাও পালিয়ে যাবে। গতকালের ঘটনা থেকে শুরু করে এখন তার কাছে আসা পর্যন্ত ঘটনার সমস্তটা শোনার পর কামিনী বলেছে- "তার সাথে থাকা বা অনত্র্য পালিয়ে যাওয়ার এটা সঠিক সময় নয়, হয় সে রাজন্যার মরার খবর এনে দেবে অথবা সে রাজন্যাকে ডিভোর্স দেবে। একমাত্র এই শর্তে কামিনী স্বাধীনের সাথে থাকবে। যতদিন তা না হয় ততদিন পর্যন্ত লড়াইটা একাই লড়তে হবে তাকে।"
নাট্য-অপেরার আর এক নায়িকা শিউলি ঘোষের বাড়ি বেশ কিছুটা দূরে, স্বাধীন যখন শিউলির বাড়ি এসে পৌঁছয় তখন সকাল পেরিয়ে ভরদুপুর হয়ে এসেছে। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় শিউলির বরটা একটা দুর্ঘটনায় মারা যায়। ছেলেপুলে হয়নি। অতএব শিউলি একদম একা থাকে। বাড়িঘরদোর টাকাপয়সা থাকলেও একাকিত্ব দূর করতে আর কিছু রোজগারের জন্য স্বাধীনের নাট্যদলে নাম লিখিয়েছে শিউলি। স্বাধীনও শিউলিকে হতাশ করেনি। পাড়ার লোক শিউলিকে অপয়া, বাঁজা বলে একঘরে করে রেখে দিয়েছে। শ্বশুর অনেক আগেই মারা গেছে ছেলের শোকে শাশুড়িও দেহ রেখেছেন। অসময়ে ঘরে কড়া নাড়ার আওয়াজে দরজা খুলতেই স্বাধীনকে দেখে চমকে উঠে শিউলি।
- এ কী! মুখ চোখের কী অবস্থা! কোথা থেকে এলে?
-আগে ভেতরে ঢুকতে দাও বলছি। শিউলিকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে সময় নষ্ট না করে নিমেষে ভেতরে ঢুকে পড়ল স্বাধীন। দরজা বন্ধ করে শিউলি স্বাধীনের কাছে এসে দাঁড়াতেই স্বাধীন জড়িয়ে ধরলো শিউলিকে। এর আগেও স্বাধীন শিউলিকে জড়িয়ে ধরেছে, আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছে। দুজনেই মনসমুদ্রে ডুবে সুখের মুক্ত কুড়িয়েছে, সেটা নিছক বাড়তি ভালোলাগার খাতিরে। স্বাধীনের বউ রাজন্যাকে সম্মান দিয়ে বাড়তি সময়টুকুতে নিজের যৌবনের জ্বালা মেটাতে স্বাধীনের কাছে এসেছে শিউলি। নিয়মমাফিক নয় কদাচিৎ। সে কখনও চায়নি স্বাধীনের দাম্পত্য সুখ নষ্ট হোক। অর্থাৎ লুকিয়ে লুকিয়ে যতটুকু পেয়েছে সেটুকুই গ্রহণ করেছে সাগ্রহে। আজকের জড়ানোতে তো পরকীয়া নেই, বরং মিশে আছে আশ্রয় খোঁজার আকুতি।
স্বাধীনের অস্থির অবস্থা দেখে শিউলি কিছু জিজ্ঞেস না করেই যথাসাধ্য সেবাপরায়ণতার পরিচয় রাখল। এদিকে সকাল থেকে স্বাধীনের পেটে কিছু পড়েনি। হাতের কাছে যা পেল সবটুকু পেটে দিয়ে খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়ে সন্ধে হতেই বেরিয়ে পড়লো। এরমধ্যে শিউলির সাথে একটি কথাও হয়নি। মেয়েরা মায়ের জাত, মমতার খনি, স্নেহের আগার। তাই আগাগোড়া খোঁজখবর না নিয়েই সামনের মানুষটিকে ভালো রাখার চেষ্টা করে যায়। শিউলি আজ প্রেম পরকীয়া, দেনা-পাওনার হিসেব না করে অবস্থার কোন কারণ জিজ্ঞেস না করে স্বাধীনের প্রতি কর্তব্য করে গেল। অথচ স্বাধীন তাকে আঁধারে রেখে পরবর্তী ছক কষার জন্য সন্ধের অপেক্ষা করছিল। রাতের অন্ধকারে সে এলো মা'য়ের কাছে। মা'কে আগাগোড়া সব বলে এবার সে কী করবে তা জানার অপেক্ষা করতে লাগলো। মা ছেলেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেললো । মরে গেলে তার দায় নেবে না জানিয়ে দিল। তবে হ্যাঁ, যদি বেঁচে যায় তাহলে পাশা পাল্টে তাকে পুনরায় বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এসে যথারীতি অত্যাচার কায়েম রাখবে এটা আস্বস্ত করলো। তবে এই মুহূর্তে ছেলেকে সাফ জানিয়ে দিল, রাত্রে তাকে বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয়, তাই ছেলেকে বাড়ির বাইরে বের করে দরজায় খিল এঁটে দিল মা।
উফ্! এই রাত্রে কোথায় যাবে ! এর চেয়ে ভালো হত আজ শিউলির কাছে থেকে গেলে। আবার যাওয়া সম্ভব নয়, রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে যাবে। তার মা যখন বাড়িতে থাকার অনুমতি দিল না তখন সব জানার পর শিউলি কি তাকে আশ্রয় দিত? না মনে হয়। ও তো কখনও রাজন্যাকে আঘাত দিতেই চায়নি। এখন একবার কী হাসপাতালেই যাওয়া উচিত? কী অবস্থা রাজন্যার ? একটা দিন পার হয়ে গেল, তার কী জ্ঞান ফিরেছে? মরে গেলে অবশ্য খবরটা চাপা থাকতো না। আর কোন উপায় না দেখে হাসপাতালেই এলো সকলের আড়ালে চোরের মত। আজকের রাতটা এখানে কাটিয়ে খুব ভোরে অন্য কোথাও পালিয়ে যাবে বরং। এখন কীভাবে রাজন্যার বর্তমান অবস্থার কথা জানা যাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথাই ভাবতে লাগলো। এরমধ্যে পরিচিত কারো নজরে এলে নাটুকেপনায় বুঝিয়ে দেবে রাজন্যার জন্য সে এতটাই ভেঙে পড়েছে যে হাসপাতালের এককোণে উন্মাদ হয়ে ভালো খবরের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে।
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ