সংসার গোছানোর জন্য মানুষের কত পরিকল্পনা, কত স্বপ্ন, কত আকাঙ্ক্ষা থাকে। একজীবনে হয়তো সবটা তার পাওয়া হয় না, তবু কিছু কিছু তো ছকেবাঁধা জীবন উপভোগ করে সে। এক রাজন্যা যার জীবনে পরিকল্পনা করার মত সুযোগ আসেনি, সে স্বপ্ন দেখার অবসর পায়নি। আর আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবার আগেই প্রতিবার ঝড় এসে সবটা তছনছ করে দিয়ে গেছে। হ্যাঁ এক অদম্য জেদ আর হার না মানা মানসিকতা তাকে ঋজু করে রেখেছে। তার সংসার থেকেও নেই। যে স্বামীর জন্য আমরির এককোণে নাওয়া খাওয়া ভুলে ঈশ্বরের দরজায় বেহুলার মত একা সংগ্রাম করে যাচ্ছে; সে নিশ্চিত জানে স্বামী যদি বেঁচে যায় তাহলে তাকে প্রত্যাখান করে, সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করবে। আর সমস্ত ব্যাপারে সে যতটা কঠোর স্বামীর ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। তার সমস্তটা দিয়েও স্বাধীনকে শোধরাতে পারেনি; হয় এটা তার ব্যর্থতা নয়তো নিয়তি। তবু বৃথা আশা এইবার অন্তত স্বাধীন তাকে বুঝুক! কে জানে সে বাঁচবে কী না! আই সি সি ইউ-তে নিয়ে যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে গেছে এখনও চিকিৎসায় সাড়া মেলেনি। তবে ডাক্তারবাবুদের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে মুমূর্ষুকে বাঁচানোর, এটা রাজন্যা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে।
যে মানুষটার কাছে কেবলমাত্র অত্যাচার, অবহেলা, উপেক্ষা আর লাঞ্ছনা পেয়েছে সেই মানুষটিকে বাঁচিয়ে তোলার এত তাগিদ কেন তার সহজাত বুঝতে পারে না। মন এক বিচিত্র অনুভূতির জন্ম দেয় যার রাশ ব্যক্তির হাতে থাকে না। চরম উৎকণ্ঠায় রাজন্যা কিছু মুখে তুলতে পারছে না, রাজর্ষির খোঁজ পর্যন্ত তেমনভাবে নিতে পারছে না। এতটা অস্থিরতার মধ্যে তাকে স্তোকবাক্য শোনাবার মতো কেউ নেই। শাশুড়ির এত আদরের ছেলে মৃত্যুর সাথে হোলি খেলছে অথচ একটা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না। যারা সাথে এসেছিল সবাই আমরিতে পৌঁছে দিয়েই যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। এই এতবড় হাসপাতালে রাজন্যা একদম একা! বোকার মত প্রতীক্ষা করছে কতক্ষণে স্বাধীনের হুঁশ ফেরে। এমনসব ভাবনার মাঝেই সিস্টার এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু খোঁজ করলেন-
-আপনি কি কোন মেডিসিন নেন?
-হ্যাঁ। অ্যামিক্সাইড...
ব্যাস্ এ পর্যন্ত। তারপর আরো চব্বিশ ঘণ্টার পর জ্ঞান ফিরলো স্বাধীনের। ছুটে গিয়েছিল রাজন্যা। একবার চোখের দেখা দেখার জন্য! সে কী ছুট! না তখনই তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বাইরে আরো বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্বাধীনকে দেখার অনুমতি পেয়েছে। চোখ দিয়ে কখন আনন্দে নেমে এসেছে জলের ধারা। সে পেরেছে তার সিঁদুরের মান রাখতে।
রিক্ত, জীর্ণ মুখে ফাইট করার চাপ স্পষ্ট। ঘোরের মধ্যে থেকে গেছে তখনও। ভাবলেশহীন মুখে কিছুই যেন সনাক্ত করতে পারছে না! সে কে! কী তার পরিচয়! এখানেই বা কেন! কেন বা তার সমস্ত শক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে! রাজন্যা সমস্তটা অনুভব করতে পারছে, বলতে পারছে না কিছুই। মনে মনে বলছে হয়তো- "হে ঈশ্বর স্বাধীনকে তার শক্তি ফিরিয়ে দাও, ওকে তুমি ভালো করে দাও।" যমের দুয়ার থেকে রাজন্যার কাছে ফিরেছে স্বাধীন। জনে জনে খবরটা দিতে থাকলো রাজন্যা। কেউ খুশি হলো, কেউ বা মনে মনে বলল- 'ঢঙের শেষ নেই', বেঁচে গেছে মানে ওর হয়ে গেল?' বরং ওর জন্য আরও দুর্দিন আসতে চলেছে... আরও দুদিন পর কথা বলার শক্তি ফিরে পেল স্বাধীন। ফোবিয়া তখনও কাটেনি... বিড়বিড় করে বলে চলেছে....."আচ্ছা, রাজন্যা আমায় চিনতে পারছে না কেন?" "ও কি আমাকে ভুলে গেল?" "ও কি আমার উপর এখনও রেগে আছে?"...এই সমস্ত বলে চলেছে। যাক্ বিপদ কেটে গেছে আর চিন্তার কিছু নেই। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন সমস্যা এই পাঁচদিন আরও দু'দিন মোট সাতদিনের চিকিৎসার বিলটা কোথা থেকে জোগাড় হবে। ভর্তির দিন-ই তার নিয়ে আসা দশহাজার শেষ। এবার কোথা থেকে পাবে এত টাকা। শ্বশুরবাড়ি থেকে কোন সাহায্য পাবে না এটা রাজন্যা ভালোমতো জানে। শেষ ভরসা বাবা। দেখা যাক্ কোন সুরাহা হয় যদি।
অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর এখনও পায়নি রাজন্যা, এটা নিয়ে মনটা অশান্তি করতে ছাড়ছে না। কেন করল স্বাধীন এমনটা? কী হয়েছিল ? কার সাথে? কতগুলো ওষুধ খেয়েছিল? জানা গেছে তার অ্যামিক্সাইড গরম জলে বা চায়ের সাথে গুলে খেয়েছিল কিন্তু কতগুলো? ওষুধের পাতাগুলো তাড়াহুড়োয় চেক করা হয়নি। চেক করলেও হয়তো বলতে পারতো না কারণ অনেকগুলো ওষুধ একসাথে কেনা থাকে। সে রাতে একটা ওষুধ নিলে সকাল অবধি এমনভাবে ঘুমোয় যে মুখে মাছি ঢুকে গেলেও নির্দিষ্ট সময়ের আগে ঘুম ভাঙে না। আর স্বাধীন কতগুলো ওষুধ খেয়েছিল যে নানা পদ্ধতির চিকিৎসার পরেও বাহাত্তর ঘণ্টা পরে তার হুঁশ ফিরলো! শুধু বাহাত্তর ঘণ্টা নয় আরোও প্রায় একটা দিন থেকেছে মাধবপুর হাসপাতালে। নাহ্ মানসিক টানাপোড়েন সে কাঠকয়লায় না হওয়া পর্যন্ত থেকে যাবে মনে হচ্ছে। এসব থাক্ বরং..আগে টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। দুটো দিন হাতে আছে তার আগেই টাকাটার ব্যবস্থা না করলে স্বাধীনকে ছাড়বে না .. অতএব বাবাকে ফোন করে রাজন্যা...
-হ্যাঁ বল্...খবরটা পেয়েছি...কবে ছাড়বে?
-আর দুটো দিন পর...বাবা বিলটা তুমি দিয়ে রাখবে? পরে আমি দিয়ে দেব..
-বেশ, পরিমাণটা জেনে বলিস। আমি দেখছি...
-তুমি কি আসবে?
-হ্যাঁ আসছি। কোথায় উঠবি ভেবেছিস?
-ফ্ল্যাটেই।
-ঠিক আছে। রাখ্।
বাবা ফোন কেটে দিলে, রাজন্যা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক্ দায়িত্ব না নিক্ অন্তত সময়ে টাকাটা দিয়ে সাহায্য করার ভরসা দিয়েছে এটাই যথেষ্ট!
-এরপর আগামী সপ্তাহে......
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ