Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি / রঙ্গনা পাল / পর্ব-৪২


ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি / রঙ্গনা পাল / পর্ব-৪২

       

  আটদিনের দৌড়ঝাঁপ শেষে ফ্ল্যাটে ফিরলো রাজন্যা।  রাজর্ষির দিকে তাকানো যাচ্ছে না, সে যেন একেবারে মনমরা হয়ে আছে। তার জীবনে বয়ে যাওয়া ঝড়ের দাপট রাজর্ষিকেও বিদ্ধস্ত করে দিচ্ছে। রাজন্যা সবটা বোঝে কিন্তু তার করার কিছু নেই। থেকে থেকে ছেলের দৈন্য দশা দেখতে হয়। বাবাকে সুস্থ দেখে ভালো লাগলো রাজর্ষির, কিন্তু বাবা এখানে থাকবে জেনে সে কেমন যেন সংকুচিত হয়ে আছে। ছোট থেকে বাবার আদর ভালোবাসা কী তা রাজর্ষি জানে না। হয়তো সেই কারণেই বাবার প্রতি আনুগত্য জন্মায়নি।

এই কদিনে রাজন্যার কম ধকল গেল না, বেশ কিছুদিন সময় লাগবে নিজেকে গোছাতে। এদিকে তার চাকরি কাকদ্বীপে বদলির নির্দেশ এসে গেলো। আগামী তিনদিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে।  স্বাধীনও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। আরও কিছুদিন ওর পাশে থেকে দেখাশোনা করতে পারলে ভালো হতো। মাধবপুর থেকে কাকদ্বীপ যাতায়াত করা খুব একটা সহজ হবে না, কারণ দূরত্ব প্রচুর। যাওয়া-আসা নিয়ে প্রায় ঘণ্টা ছয়েকের মতো লাগবে। আবারও একটা গুরুগম্ভীর চাপ এসে গেল মাথার ওপর। জয়েন না করলে ছেলেকে মানুষ করবে কী করে! নিজের পেট বা চলবে কি করে! বিয়ের পর থেকে ভাত, কাপড় কোন দায়িত্ব তেমনভাবে নেয়নি স্বাধীন। তখনও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র সম্বল ছিল এই চাকরিটা, এখনও তাই। বরং এখন কতদিন যে স্বাধীনের খরচ বহন করতে হবে কে জানে! অবশ্য স্বাধীন বরাবরের জন্য রাজন্যার কাছে থেকে গেলেও তার কোন অসুবিধা হবে না, সে তো বরাবর স্বাধীনের সাথেই থাকতে চেয়েছে। 


         রেণুকাকে স্বাধীনের কাছে রেখে চাকরি করতে যেতে মন সায় দিচ্ছে না, অতীত অভিজ্ঞতা অলক্ষ্যে চাবুক মারছে হৃদয়ে। রাজর্ষির জন্যও এতদূরে চাকরি করতে মন চায় না। রাজন্যা ভেবেছিল এখন কিছুদিন ছেলেটার সাথে থেকে তার মনোবল বাড়িয়ে তুলবে। নাহ্ এখানেও বিধির চোখরাঙানি! এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটল যে, পূর্বের সমস্ত পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ল। বার বার রাজন্যার অতীত অভিজ্ঞতা চোখের সামনে ভেসে উঠছে; সে নিজে বাবা মা'র কাছ থেকে কতটা অবজ্ঞা পেয়ে এসেছে! এখন মা হিসেবে নিজের ছেলেকে মায়ার আঁচলে রেখেও ঠিকঠাক যত্ন-আত্তির করতে পারছে না।  পরিস্থিতি সবসময় কানমলা দিয়ে শেখাচ্ছে, অদৃশ্য ডানা থাকলেও ইচ্ছেরা সবসময় ডানা মেলতে পারে না। কারণ তাদের নিজস্ব কোন আকাশ নেই। ওদিকে, অদ্ভুত স্বাধীনের পরিবার! স্বাধীন সুস্থ হয়ে ফেরার পর নিজের বাড়ির লোকেরা কেউ দেখা করতে এলো না! রাজন্যা আশা করেছিল ও বাড়ি থেকে স্বাধীনের মা অন্তত আসবে। দুটো দিন পার হয়ে গেল, আসা তো দূর কেউ ফোন করেও খবর নেওয়ার সৌজন্য প্রকাশ করলো না। স্বাধীনের পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও তারা স্বাধীন আমরিতে ভর্তি থাকাকালীন টাকাপয়সার ব্যাপারে কোন কৌতূহল দেখায়নি। ভাগ্যিস তার বাবা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল! ভাবটা এমন যে, ছেলে মরলো বা বাঁচল কোনটাতেই তাদের কিছু এসে যায় না। স্বাধীনের যত কুকর্মের সাক্ষী থাকাটাই বোধহয় ওর মায়ের একমাত্র ব্রত, ব্যাস্ এ পর্যন্তই! বাকি ছেলের হিত চিন্তা করার মানসিকতা বোধহয় নেই।


            নির্ধারিত দিনে কাকদ্বীপে জয়েন করার দিন এসে গেল। সমস্ত স্নেহ মায়া মোহ উদ্বেগ ফ্ল্যাটে রেখে যেতে হলো চাকরিস্থলে। নিজের ডিউটি বাদ দিয়ে বাকি ছ'ঘণ্টার যাতায়াত সত্যি অসহ্য হয়ে উঠলো রাজন্যার কাছে। মর্নিং ডিউটি তবুও সহ্য করা যায়। ইভিনিং ডিউটি করার পর ওখানেই থেকে যেতে হবে। মানসিক অবসাদ বাড়ছে। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। এভাবে কতদিন চালাতে পারবে সে জানে না। ডিউটি থেকে ফিরে সমস্ত এনার্জি হারিয়ে যাচ্ছে। না ছেলেকে সময় দিতে পারছে, না স্বাধীনের দিকে নজর দিতে পারছে। অবসাদময় দিন কাটছে। ওষুধ রোজ নিচ্ছে তবু মাথাটা গড়বড় করছে। উল্টোপাল্টা সব চিন্তা আসছে। একটা ঘোর কাজ করছে যখন তখন হেসে ফেলছে। রেণুকা হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, রতনটাটা আমার বাড়িতে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়েছে। কথা দিয়েছে আমাকে তার বিজনেস পার্টনার করবে। কখনো বলছে দাদাগিরির মঞ্চে সৌরভ গাঙ্গুলিকে সে গান শোনাচ্ছে....রেণুকা বুঝেছে রাজন্যার পাগলামি বেড়েছে।


      স্বাধীন এখন পুরোপুরি সুস্থ। সে এখান থেকেই আবার তার চাকরিটা কন্টিনিউ করছে। বাড়ির সাথে তেমন একটা যোগাযোগ রাখেনি। খানিকটা হলেও রাজন্যার প্রতি দায়িত্ববোধ জেগেছে। সেও বুঝতে পারছে, ওষুধের পাওয়ার বাড়াতে হবে। ডাক্তারের সাথেও কনসাল্ট করতে হবে। এই অবস্থায় মাস তিনেক ডিউটি করার পর সার্ভিস ব্রেক করে দিল রাজন্যা। হাওয়া বদলের জন্য স্বাধীন রাজন্যাকে নিয়ে কাশী বেড়াতে গেলে সেখানে শিবলিঙ্গ কুড়িয়ে পায় রাজন্যা। এখানে তার নতুন দীক্ষা হয়। বাড়ি ফিরে সেই  শিবলিঙ্গ মহা সমারোহে প্রতিষ্ঠা করে। কিছুদিন পর হঠাৎ  রাজন্যার মাথায় জটা পড়তে শুরু হয়। এখন থেকে সে সংসারের মোহ কাটিয়ে পুরো আধ্যাত্মিক চেতনায় মুড়ে ফেলে নিজেকে।


                -এরপর আগামী সপ্তাহে....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ