Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ধারাবাহিক উপন্যাস:ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল -পর্ব-১২




ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল


          সকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। ভাদ্রের পচা গরম খানিকটা হলেও কম। সাধারণত এই সেপ্টেম্বর নাটকের জন্য মোটেই উপযুক্ত সময় নয়, শীতের দিনেই নাটকের বায়না বেশি থাকে।  ৫ই সেপ্টেম্বর দিনটিতে খানিকটা চ্যালেঞ্জিং মুড নিয়েই নাটকটা মঞ্চস্থ হবার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। পরিমল এই নাটকটির সন্ধান দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু নির্ধারিত দিন ঠিক হয়েছিল বাসবের আবদারে।  নাটক পাগল স্বাধীন তার সাথে বাসব সহ পাড়ার সুপ্রতিষ্ঠিত ছাত্রেরদল  গ্রামের সংস্কৃতিবান মাস্টারমশাইকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চলেছে। ফলে  প্রত্যেকের মধ্যেই দারুণ একটা আবেশ কাজ করছে। বাসব পাড়ার গর্ব। বিদেশে ডাক্তারি করে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাবা মাকে সাথে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেবে বলে খুব কম দিনের জন্য দেশে ফিরেছে। স্বাধীনও বর্তমানে ভালো চাকরিতে যোগদান করেছে। শঙ্কর গ্রামীন ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। অর্ণব প্রতিষ্ঠিত উকিল। এরকম আরও অনেকে মিলে তাদের আদর্শ শিক্ষকের জন্য এই নাটকটি উৎসর্গ করতে চলেছে। মেয়েদের প্রতি আসক্তি বাদ দিলে স্বাধীনদের ব্যাচের প্রত্যেকের জন্য স্বাধীন বন্ধুবৎসল। শুধু জগৎপুরের প্রণয়ের প্রতি তার বন্ধুবৎসলতার নিদর্শন নেই কোথাও।


            ব্রাহ্মণবেড়িয়ার মাস্টারমশাই-এর একটা  ইতিহাস আছে। কল্পনা তেলমিলের মালিক সুভদ্র সৎপতির একমাত্র পুত্র ধ্রুপদ সৎপতি।  সুভদ্রবাবু তার ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন শুধুমাত্র তার ব্যবসার হিসেবপত্রাদি দেখে ব্যবসাটার উন্নতির জন্য। তিনি নিজে খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি বলে একটা খেদ ছিলো, ভেবেছিলেন ছেলে তার স্বপ্ন পূরণ করবে, ব্যবসাটার প্রসার ঘটাবে কিন্তু ব্যবসার ধারে কাছে এলেন না ধ্রুপদবাবু। বাবার তেলমিলের গদিতে না বসে  মাস্টারি করে এসেছেন। তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে কৃতী ছাত্রছাত্রীরা। তাঁর সময়ে শিক্ষকদের বেতনের হার এত কম ছিল যে সেই টাকায় সংসার প্রতিপালন করা ছিল দুরুহ, কিন্তু ছাত্র/ছাত্রীরা তাদের শিক্ষককে মান্য করতো, সমীহ করে চলতো। সুভদ্রবাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন অভাব ছুঁতে পারেনি স্যারকে,  কোনদিকে না তাকিয়ে ধ্রপদ স্যার নিজেকে উৎসর্গ করে ছাত্র গড়েছেন ধর্মের পাত্রে। বিয়েটাও করা হয়ে ওঠেনি‌। বাবার মৃত্যুর পর না পেরেছেন ব্যবসা বাঁচাতে না পেরেছেন আর্থিক নিরাপত্তা আনতে। একসময় দেখাশোনার অভাবে তেলমিল বন্ধ হয়ে যায়। জমা সম্পত্তির পরিমাণ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকে। যে মাস্টারমশাই ছাত্র গড়তে গড়তে নিজের জীবনের দিকে তাকাবার সময় পাননি সেই মাস্টারমশাই তো ছাত্রদের কাছে আদর্শ হবেনই। বর্তমানে তিনি দুরারোগ্য মারণ ব্যাধিতে ভুগছেন, তাই ৫ই সেপ্টেম্বর তাঁকে সম্মান জানাতেই এই নাটক উপস্থাপনার আয়োজন করা হয়। 


       ৫ই সেপ্টেম্বরের শুভ মহরতে  নন্দিনী নাট্যমঞ্চ জমজমাট। এসেছেন, প্রিয় ধ্রুপদ স্যার। এসেছে সপরিবারে কৃতি ছাত্ররা, বলাবাহুল্য গ্রাম ভেঙে এমনকি পাশের গ্রামগুলো থেকেও অনেকেই জড় হয়েছেন নাট্যমঞ্চে। বৃষ্টিও সমানে  সংগত করে চলেছে। রাজন্যার আসার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। নন্দিনী নাট্যশালায় নাটক মঞ্চস্থ হবার পূর্বে ধ্রুপদ স্যারকে মঞ্চে সম্মাননা প্রদর্শন করা হলো। স্যারের ভাঙা গলাতেও শোনা গেলো বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। গুরুদক্ষিণায় ভরে গেলো পদতল। আসক্তি বিহীন এই আদর্শ শিক্ষক গ্রহণ করলেন না কিছুই শুধু বললেন, তিনি গর্বিত এইসব ছাত্রদের জন্য। তাঁর শেষ ইচ্ছে, শিক্ষাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে যেন উপযুক্ত পাত্রে প্রতিষ্ঠা  করা হয়, সকলের প্রচেষ্টায় এই গ্রামে যেন গড়ে তোলা হয় বিবেকানন্দ শিক্ষা নিকেতন, যেখানে বিনা স্বার্থে শিক্ষককেরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবেন, ছাত্ররা মুক্ত মনে সেই আলোয় খুঁজে নেবে ভবিষ্যতের দিশা এটাই হবে তাঁর প্রতি উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা। উপস্থিত সকলের মন্ত্রমুগ্ধতা বুঝিয়ে দেয় স্যারের প্রতি সকলের  শ্রদ্ধা কতখানি।


         বৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জমে উঠলো নাটক 'সুধাময়ীর নৃত্যসুধায় '। স্বাধীনের অভিনয় খুব প্রশংসিত হলো। সাথে সুধাময়ীর চরিত্রে মনকাড়া রম্ভা অরোরা সবার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিলো। অবশ্য রম্ভাও একবাক্যে মেনে নিলো স্বাধীনের নাট্যাভিনয়ের কুশলতা। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে স্বাধীনের সাথে অভিনয় করতেও আগ্রহ প্রকাশ করে গেল। ধ্রুপদস্যার প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন স্বাধীনকে। গর্বিত হলেন তাঁর ছাত্রের দায়িত্ব, কর্তব্যপরায়ণতায়। বন্ধুরাও এগিয়ে এসে করমর্দন করে গেলো‌।পরবর্তীতে এমন অনেক নাটকের দাবিও উত্থাপিত হলো। এতো প্রশংসার আড়ালেও কেমন যেন বিষণ্ণতা গ্রাস করলো স্বাধীনকে। একটা সুপ্ত ইচ্ছেয় জল ঢেলে দিল রাজন্যা! স্বাধীনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো এখানে একবার এলে রাজন্যা তাকে ঠিক আপন করে নিতে পারতো। উফ্! এতো সাফল্যের পরেও মনে এতটুকু শান্তি পাচ্ছে না, প্রতীক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে কে জানে!! ভাগ্যের হাতে ছাড়তে পারবে না সবটা, তার চেয়ে আরো ভালো করে সবটা প্ল্যান করবে না হয়, নয়তো সবটা ভেস্তে যেতে পারে‌। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করবে রাজন্যার সাথে। 

                এরপর আগামী সপ্তাহে .....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ