Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল : পর্ব-১৩

 


ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল


         রাজন্যা ছোটবেলা থেকে অবহেলা সহ্য করে আসছে, সে জানে অবহেলার একান্নপীঠ। স্বাধীন বার বার তার কাছে আসে, অথচ রাজন্যা অবহেলার সাথেই তাকে ফিরিয়ে দেয়। প্রথমবার অবশ্য ফিরিয়েছে হীনমন্যতায়। তখন ভেবেছে সে স্বাধীনের যোগ্য নয়‌। যে নিজের বাবা মা'র ভালোবাসা পায়নি, তাহলে অন্যের ভালোবাসা কীভাবে পেতে পারে! দ্বিতীয়বার কলেজ স্কোয়ারে দেখা হবার পর রাজন্যা মুখের উপর বলে দিয়েছে সে একমাত্র প্রণয়কেই ভালোবাসে। প্রণয় যদি কখনো তার জীবনে ফিরে নাও আসে তবু স্বাধীনকে ভালোবাসতে পারবে না। কারণ স্বাধীনের জন্য তার কোন অনুভূতি নেই। স্বাধীন এতটুকু সরেনি তার নিজের জায়গা থেকে। প্ল্যানমাফিক তার মাকে দিয়ে ফোন করিয়েছে, বার বার দেখা করতে আসাতেও বিরতি নেই। স্বাধীনের লজিক রাজন্যা দেখা করতে তো আসে, এতেই হবে। একদিন নিশ্চয় রাজন্যার মনের ভাব পরিবর্তিত হবে। সে তো একটা মেয়ে, তার শরীরে মায়া, মমতা নিশ্চয় আছে। কতদিন থাকবে স্বাধীনের থেকে মুখ ফিরিয়ে? স্বাধীন হারতে চায় না, সে আশাবাদী। সে যতবার দেখা করতে আসে, ততবার জেদ চেপে যায়, একদিন নিশ্চয় নিজের করে পাবে রাজন্যাকে।


      দিনের টুকিটাকি চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষতে কষতে সময় কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে থাকে। বছর গড়িয়ে চলে নদীর ধারার মতো এঁকেবেঁকে। রাজন্যা সেকেন্ড ইয়ারে ব্লু বেল্টে প্রবেশ করে। আগের কাজগুলো আরো যত্নের সাথে ঝটপট করে ফেলে, রোগীর দেখাশোনা থেকে আরম্ভ করে তাদের যাবতীয় খেয়াল রাখা তো আছেই, এ সময় আবার ইনজেকশন দেওয়া শেখে। প্রথম ইনজেকশন দেওয়ার অভিজ্ঞতাও  মনে রাখার মতো। সিরিঞ্জকে সম্পূর্ণভাবে বাতাস মুক্ত করে, তার মধ্যে লিকুইড প্রবেশ করিয়ে প্রথমাবস্থায় সঠিক শিরা খুঁজে বার করে শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করা সে বিরাট ঝক্কির মনে হলেও, যখন এই কাজটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় তখন মনে হয় এ তো ভীষণই সহজ। রাজন্যার বয়সী একজনকে প্রথম ইনজেকশন পুশ করতে গিয়ে সে এক বিশাল ব্যাপার-এ দাঁড়ালো যেন। ইনজেকশন পুশ করার পর সেও এমন ভাব করে যেন ঈশ্বরের কৃপায় এইমাত্র বেঁচে গেল আর কী! পরে পরে অবশ্য বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইনজেকশন পুশ করার কৌশল শিখেছে। ওই প্রথম দিন ছাড়া বাকি কোনক্ষেত্রে তেমন অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি।


        ট্রেনিং-এর সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়টা এখন স্বাধীন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে রাজন্যার মনে। সে ভাবছে স্বাধীন তার কাছে ছুটে আসে একটু ভালোবাসার আশায়, সে কী না স্বাধীনের প্রতি অবহেলা করে ফেলছে! মন নয় এবার মাথা খাটিয়ে বিষয়টাকে দেখে সে স্থির করলো আর অবহেলা নয়, একটু ভালো ব্যবহার তো করা যেতেই পারে। হ্যাঁ কানাকানি শুনেছে স্বাধীনের একটু মেয়েবাতিক আছে, যদি তাই হয় তাহলে কেন রাজন্যার কাছে ছুটে ছুটে আসে? শারীরিক লক্ষণ ছাড়া আর কিই বা আছে, গায়ে রঙটাও তো নেই। শুধুমাত্র শরীরের গন্ধে তার কাছে আসছে স্বাধীন, এটা কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে। যদি তাই হয়, তাহলে তো তাকে নানা অছিলায় ছোঁয়ার চেষ্টা করতো, কই তেমন নমুনা নেই! বরং ধীরে ধীরে স্বাধীন রাজন্যার কাছে বিনয়ী, ভদ্র হয়ে উঠছে। সুন্দর একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে তার জন্য। স্বাধীনের মা'র তো তুলনা হয় না, পারিবারিক ব্যবসা সামলেও ছেলের জন্য সময় দেন, নিয়ম করে রাজন্যার খোঁজ খবর নেন। একটা মেয়ে তার জীবনে আর কি চায়? একটা ভালো ঘর, ভালো বর আর ভালো শাশুড়ি যদি মায়ের জায়গা নেন, মন্দ কী!

না, আর কোনভাবে স্বাধীনকে দূরে ঠেলা যাবে না, প্রণয়ের মতো ভালোবাসতে না পারলেও সংসার করতে করতে ঠিক ভালোবাসা জেগে উঠবে।


        চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে স্বাধীনের। ওই একরত্তি মেয়েটা তাকে অবলীলায় উপেক্ষা করে যাচ্ছে, কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। আর কতদিন? উফ্...ধৈর্য্যের চরমসীমাও অতিক্রম করে যাচ্ছে, রম্ভার মতো সুন্দরী তন্বী আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মহিলাও স্বাধীনের উপর ক্রাস খাচ্ছে আর এই রাজন্যা  নিজেকে কী ভাবে কে জানে! কীসের এতো অহংকার? কী আছে শরীরটা ছাড়া? নেহাত ওই ডাসা শরীরটা তাকে নেশাড়ু করে তুলেছে, নইলে ওর পেছনে অযথা সময় নষ্ট করার মতো মানসিকতা নেই তার। বিয়ের প্রস্তাবেও সে রাজি না! এই বিশ্ববাংলা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও স্বাধীনের মতো পাত্র পাবে সে? আর প্রণয়? সেই গাঁইয়াটা কী জাদু করেছে রাজন্যার উপর যে তার অদৃশ্য ল্যাজ ধরে কেবলই টান মারছে রাজন্যা? প্রণয়কে আদৌ পুরুষ বলে মনে হয় না সে তো বরাবরের ল্যাদা। রাজন্যাকে যদি কেউ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে, সে একমাত্র স্বাধীন। তার ধারে পাশে কেউ ঘেঁষতে পারবে না। বেশ, পণ যখন করেছে তখন আরো কিছু সময় অপেক্ষা করে নেবে না হয়, তবু একটা মেয়ের কাছে কখনো হারবে না স্বাধীন।


        হাসপাতালে এক তরুণ নিউরো সার্জেন জয়েন করলেন, সকলে কিছু সময়ের জন্য জমায়েত হয়েছে, এসেছে রাজন্যাদের টিমও এই উপলক্ষ্যে একটু মিষ্টিমুখ হলো। আলাপ পরিচয় হলো।  মিটিং হলে খানিক উপস্থাপনা হলো সদ্য জয়েন করা ডাক্তারবাবুর। হাসপাতালের  ডক্টর, নার্স, স্টাফ ছাড়িয়ে কেমন করে যেন রাজন্যার সাথেও ডঃ দিব্যাংশু দেশপান্ডের সাক্ষাত হলো, বেশ ভালো লাগলো রাজন্যার। অন্যদিকে প্রথম পরিচয়ে ডঃ দিব্যাংশুও সবাইকে ছেড়ে কাকতালীয়ভাবে রাজন্যার প্রতি সামান্য নজর দিলেন। পরিচয় প্রাক্কালে তিনি বলেন ফেললেন রাজন্যা নামটাই তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় লেগেছে। তখনকার মতো এটুকুই। যে যার নিজের মতো জায়গায় চলে আসে। পরিবর্তনশীল জগতে নিত্য নতুন ভালো মন্দ কত যে ঘটনার মধ্য দিতে যেতে হয় তার হিসেবের ফর্দটা এতোটাই লম্বা হয় যে সহজে সবকিছু মনে রাখা দায়। তবু যেটুকু ভালোলাগা বিষয়ের মধ্যে মিশে থাকে তাকে সযত্নে লালন করতে বেশ লাগে রাজন্যার। অনেকদিন হলো দক্ষিণের জানালা আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা গাছপালা আর মেঘেদের দেখা হয় না। অবশ্য অবসরে মাঝেমাঝেই হোস্টেলের পিছনদিকের গাছগাছালিকে ঘিরে সে পুরানোর স্মৃতিচারণে নিজের মতো করে ভালো থাকার পথ খুঁজে নেয়। ভবিষ্যতের কথা বলবে তো ভবিষ্যৎ, আশার তরী এখন যে ভাবনায় ভাসছে।


                 ----এরপর আগামী সপ্তাহে......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ