Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি / রঙ্গনা পাল :পর্ব-২০



 ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি

     নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে খানিক সময় তো লাগেই। রাজন্যার কোন ব্যস্ততা নেই। হতে পারে পরিবেশটা মানানসই না তবু অদ্ভুত এক শান্তির খোঁজ পেল সে। মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন চেনা প্রকৃতি, পরিত্যক্ত প্রেম ইত্যাদিকে পিছনে ফেলে অবশেষে স্বাধীনতার সুখ পেল। এবার হয়তো নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের উপর ভর করে স্বপ্নের বীজ ছড়াতে পারবে আবাদ মনের আঙিনায়। সবটা সয়ে যাচ্ছে অল্প অল্প করে, তবে যেদিন রাতে ডিউটি থাকে সেদিনটা কাজে কর্মে কাটে বাকি দিনগুলো বড় দুশ্চিন্তায় অতিবাহিত করতে হয়। সহকর্মীদের মুখ থেকে রাজন্যা ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে বাংলাদেশে গরু পাচারের রাস্তাটা তাদের কোয়াটারের পাশ দিয়েই, যে আওয়াজ পেয়েছে আগেই। অতএব কোয়াটারে যাপিত রাতগুলোতে একটু বেশি মাত্রার নিস্তব্ধতা তখন দোসর হয়। চোরাচালানকারীরা না জানি কতটা ভয়ঙ্কর! যদি ভালো মন্দ ঘটে যায়! তার ইহকাল পরকাল বলে কেউ না, কিছু না থাকলেও এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কে যেতে চায়! অবুঝ মনের সাথি হতে তখন জীবাত্মার ছটফটানি শুরু হয়ে যায়।


       প্রতিবন্ধকতার টপকানো বেড়া ডিঙিয়ে বাইরের খোলা আকাশ দেখা এখন রাজন্যার একটা বাড়তি কাজ বলা যায়। এ আকাশ মনের আকাশ, আবার কল্পনার ফানুসও হতে পারে। এখন তবু তো স্বপ্ন দেখতে পারে হয়তো তাই তার হৃদয়ের আরশির বিম্বিত প্রতিবিম্বে না চাইলেও স্বাধীনের মুখটা ভেসে উঠে। এক মহাকর্তব্যের অংশীদার মনে করে নিজেকে স্বাধীনের কাছে সঁপে দিতে হবে এবার। অনেকদিন যাবৎ অপেক্ষা করে আছে স্বাধীন। ইদানিং যখনই স্বাধীনের কথা ভাবে পাশাপাশি করুণ মুখের প্রণয় একসারিতে দাঁড়িয়ে পড়ে, বড় দুর্বল লাগে, বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠে‌। হাজার পিপিলিকা কামড় দেয় পুরানো ক্ষতস্থানে। রক্তাক্ত হয় হৃদয়টা। নাহ্ দুর্বল হলে চলবে না। এই তো সবে পথ চলা শুরু, আগামী দিনগুলোতে নিজেকে মেলে ধরতে আরো বেশি অধ্যবসায়ী হলো রাজন্যা।

     

     বি এম ও এইচ উচিত রয়ের আন্ডারে এখন কাজ করছে রাজন্যা। মানুষটি অমায়িক। কথা কম বলেন তবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে বেশ সচেতন । মোটামুটি সকলের ভালোমন্দের খোঁজ রাখেন এবং প্রত্যেককে সম্মান দিয়ে কথা বলেন। মানসিকতা দৃঢ় হলেও কথায় কথায় ডাক্তার নার্স-এর ফারাক বোঝান না। এই মানুষটিই সদ্য জয়েন করা রাজন্যাকে প্রথমদিন খাবারের জন্য  রান্নাঘরের হদিস দিয়েছিলেন। সেখানে আলাপ নাদুদা আর বকুলদির সাথে। এই দুটো মানুষের মুখের ভাষা বুঝতে সময় লাগলেও সুন্দর মনগুলো বুঝতে মোটেও দেরি হয়নি। এখানকার মানুষগুলোর মধ্যে পল্লীমায়ের ভালোবাসা মিশে আছে যেন। রোজ রোজ নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এর মাঝেই তেঘরিয়া ব্লকের প্রাথমিক এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গুরুতরভাবে জখম হয়ে এলো এক চোরাচালানকারী। চেহারায় পালোয়ান, ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে কিন্তু কামাল ফরিদ নাম্নী এই চোরাচালানকারীর কোন বিকার নেই। ক্রূর তামাটে মুখটা চোয়াল বরাবর লম্বা দাড়িতে ঢাকা, কপাল চওড়া চোখে সুরমা, ভান হাত মুঠো করা। গুলিটা লোকটার ডান কাঁধ ঘেঁষে গর্ত এঁকে বেরিয়ে গেছে। পিছনে বেশ কিছু বর্ডার সিকিউরিটির পুলিশ। লোকটা হাতেনাতে ধরা পড়েছে। উপস্থিত সকলে খুব ভয় পেয়েছে এটা না বললেও ফ্যাকাশে মুখগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে।


        মুহূর্ত কয়েক পর্যবেক্ষণের পর লোকটাকে চিকিৎসার জন্য ও টিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ডক্টর রয় ক্ষতস্থানে সার্জারির পর জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি করে নিলেন ওই চোরাচালানকারী কামাল ফরিদকে। ভালোই আহত হয়েছে মনে হচ্ছে। তা না হলে ভর্তির দরকার ছিলো না। এইবার লোকটার নার্সিং-এর ভার পড়লো রাজন্যার উপর। বাকি স্টাফরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। লোকটার মুখ দেখে প্রথমটায় ভয় পেলেও দায়িত্ব যখন পেয়েছে তখন সেবা করার ভার তো নিতেই হয়। আসলে কোন মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না, কখনও পরিবেশ কখনও পরিস্থিতি তাকে অপরাধী বানিয়ে দেয়‌। রাজন্যার মাতৃবৎ সস্নেহ সেবায় কামাল ফরিদ দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে থাকে। রাজন্যার কাছে এই কামাল কখন কামালদা হয়ে উঠেছে। কামালের জীবন ট্র্যাজিডির কাছে রাজন্যার মাথা ঝুঁকে আসে, একটা শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়। কামলদার জীবনের কঠিন পরিস্থিতি তাকে চোরাচালানকারীর ছাপ্পা লাগিয়ে দেয়। 


          কামালদা তখন বলিষ্ঠ যুবা। সদ্য পাশ গ্র্যাজুয়েট হয়ে গ্রামের মাদ্রাসায় রাতের স্কুলে আরবি শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে। মাইনে সামান্য। এর সাথে নামাজ পড়ার নিয়ম, শুদ্ধ উচ্চারণ ইত্যাদির পাঠ পড়িয়ে থাকে। নাইট স্কুলের বেশিরভাগটাই বয়স্কা নারী। সাফিয়া খাতুন এদের মাঝে অল্পবয়সী যুবতী। আব্বুর বেহেশত নসীব হবার পর কোলের ভাইটাকে মানুষ করতে গিয়ে পড়াশোনা তেমন করতে পারেনি। আম্মু জামাকাপড় সেলাই করে, সাফিয়া সেগুলো যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে আসে। মা মেয়ের কায়িক শ্রমে সংসারটা কোনমতে চলে যায়। ভাইটা এখন হাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। সারাদিন ঘরের সমস্ত কাজ করে  সাফিয়া রাতের স্কুলে পড়াশোনা শিখতে আসে। সাফিয়ার সৌন্দর্য কামালকে মুগ্ধ করে। সাফিয়ার সাদির বয়স হলেও আর্থিক অসচ্ছলতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।  কামাল সাফিয়ার রূপের কাছে হার মেনে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়‌‌। এ ভালোবাসায় সাফিয়া নিজেকে এগিয়ে দিলেও দুই পরিবার এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চাইলো না। এই অবস্থায় দুজনে পালিয়ে সাদি করার সিদ্ধান্ত নিলো।



                   -এবার আগামী সপ্তাহে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ