ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি
এই আবার শ্রাবণ মেঘের আতিশয্য, গুরু গুরু গর্জনে চারদিক মাতিয়ে রাখার অভিপ্রায়। পাগলের মতো এদিক ওদিক ভেসে বেড়ানোর আকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ততা। কালো আবরণের আধারে মনকেতকী প্রস্ফুটনের বাসনা। চাতকের নির্বিঘ্নে তৃষ্ণা মেটানোর অনুকূল অবসর। রাতের পরে প্রতিনিয়ত এক নতুন সকাল আসে। অতীতের অবসাদ সরিয়ে এই সকালটা রাজন্যাকে নারীত্বের স্বাদ এনে দিল। সে পূর্ণ নারী হয়ে উঠেছে স্বাধীনের সান্নিধ্যে। এই মেয়েটা এমনই ; সামান্য যত্ন, একটু আদর আর ভালোবাসা পেতে আজন্ম বাসনা মনের মধ্যে লালন করে এসেছে। এই মেয়ে গোলাপ দেখে তার মধ্যে কীট দেখে না। সম্পর্ক বোঝে তার মধ্যে মারপ্যাঁচ বোঝে না। নিজের মন মুখ এক তাই অন্যের মন মুখের ফারাক করতে যায় না সহজে। এইটুকু নিয়েই আগামীর পথে পা বাড়িয়েছে বিশ্বাসের জিজীবিষায়।
এ বাড়ির প্রায় সকলেই একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়, একমাত্র শ্বশুরমশাই ছাড়া। স্বাধীনের ঘুমের ঘোর কাটেনি। খুব সন্তর্পণে কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে এসে দাঁড়ায় রাজন্যা। কমবেশি সংকোচ, কিছুটা লজ্জা আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় দাঁড়িয়ে পড়ে দোতলায় জানালাটার ধারে। আস্তে করে ছিটকিনিটা খুলে একটা পাল্লা বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। শ্রাবণের আকাশেও যেন লুকোচুরির খেলা। বাইরের থেকে নজর সরিয়ে ঘরের মধ্যে নজর ফিরিয়ে দেখে নিজের ঘরটা নয়, সারা বাড়িটা বেশ সাজানো গোছানো। সবার জন্যই আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে। দোতলাতেও একই ধাঁচের একটা করে ঘর সকলের জন্য রয়েছে। উপরনিচ মিলে এঁদের মোট বারোখানা থাকার ঘর। স্বাধীনরা চারভাই-এর প্রত্যেকের জন্য দু'টি করে ঘর। স্বাধীনের বাবা-মা'র ঘর ছাড়াও আরো দুটো ঘর রয়েছে। এছাড়া ঠাকুরঘর এবং রান্নাঘর। ঘরের সাথে এটাচড বাথরুম। এর আগে একবার এ'বাড়ি এসেছে রাজন্যা কিন্তু তেমন ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। বাড়ির সামনের উঠানটাও বেশ সবুজ। বাড়ির পিছনদিকে অনেকটা জায়গা পড়ে আছে। সেখানে বেশ কিছু দামি দামি গাছ লাগানো রয়েছে, ছোট্ট একটা পুকুরের মধ্যে নেমে পড়েছে সফেদার ডালপালা। সবে মিলে দারুণ একটা পরিবেশ পেয়েছে সে।
রাজন্যার ঘরটা একদম শেষ প্রান্তে। গতকাল খানিকটা কষ্টের মধ্যে অপরিমেয় স্বর্গীয় স্বাদ পেয়েছে যা তার শরীরে এনে দিয়েছে আলাদা আভরণ। "তার মধ্যে লুকানো ঐশ্বর্য আছে", একথা বলেছে স্বাধীন। সে আরো বলেছে, "ভেতরের সৌন্দর্যটাই আসল"। কালকের এই দুটো কথা মনে পড়তেই ভেতরে ভালোলাগার প্লাবন বইছে। এতো বেশি আত্মনিমগ্নতা তাকে গ্রাস করেছে যে, শ্বশুরমশাই-এর ডাকটা কানেই আসেনি। কাছে এসে যেতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো-
-কী হয়েছে বৌমা?
-কিছু না বাবা..
-তোমাকে কেমন একটা লাগছে যেন!
-ও কিছু না, চা খাবেন বাবা? আমাকে একটু রান্নাঘরটা দেখিয়ে দেবেন?
-হ্যাঁ, এসো-
রান্নাঘরে ঢোকার আগেই শাশুড়ি মা এসে বাধা দিয়ে বললেন -
-না, না মা এখন আগুনের পাশে আসার দরকার নেই। আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি ঘরে যাও।
-চা'টা করি না মা-
-একদম না, ভেতরে যাও তুমি।
অগত্যা ফিরে যেতে হলো। এসে দেখে স্বাধীন তখনও ঘুমোচ্ছে। চা নিয়ে এলেন স্বয়ং শাশুড়ি। রাজন্যা বলে
-আপনি কেন মা, আমি নিয়ে আসতাম।
-আমার ছেলের বেড-টি খাওয়া অভ্যেস। এখন তুমি শিখে নাও পরে না হয় তোমার হাতের চা খাওয়া যাবে পায়ের উপর পা তুলে।
অবশ্যই মা।
-এই নাও ধর।
চা দিয়ে শাশুড়ি বের হয়ে যাবার পর, লিকার চা দেখে চায়ের প্রতি ভক্তি উড়ে যায় রাজন্যার। তবু, খেতে হয়। নাহ্ মন্দ লাগছে না তবে কড়া দুধ চা রাজন্যার ভারি পছন্দের। চা শেষ হবার আগেই চায়ের কাপ নিঃশেষ করে স্বাধীন জড়িয়ে ধরেছে রাজন্যার কোমর। বাধ্য হয়ে চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে স্বাধীনের দিকে ফেরে রাজন্যা-
-অ্যাই তোমার মতলবটা কী বলতো?
-আদর করা।
-দরজা খোলা আছে, সে খেয়াল আছে?
-কেউ আসবে না। খোলা থাক্..
-পাগলামি করো না লক্ষ্মীটি. ...
কোন বাধা না শুনে স্বাধীন রাজন্যাকে বিছানায় এনে ফেলে। এলোমেলো ভাবে এখানে ওখানে চুমু খেতে থাকে। এই পর্যন্ত বাধা দেয়নি কিন্তু এর পরের জন্য তৈরি ছিলো না। কাল তো ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল, এখনও নিজেকে সামলাতে পারেনি, এতএব এই মুহূর্তে আর না। ঠেলে সরিয়ে দিল স্বাধীনকে। স্বাধীন তো ছাড়ার পাত্র নয়, বলে-
-তোমাকে এতটা সুখ দেব, যা তোমার কল্পনার মধ্যেও আসবে না।
-দিও, এখন না। আমি নিতে পারছি না।
-বেশ তো, যাতে তোমার ইচ্ছে জাগে তার চেষ্টাটা করতে দাও।
-নাহ্, কিছুতেই না।
রাজন্যার 'না' স্বাধীনের কানে ঢুকলো না। রাজন্যার সারা শরীরটাকে কব্জা করে নিল একেবারে। সে কেবলই দরজার দিকে লক্ষ্য রাখছে কেউ এসে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আবার মনে মনে চাইছিল কেউ এসে পড়ুক, তাহলে এখনকার মতো বেঁচে যাবে।
কেউ এলো না, একটা মাছি পর্যন্ত ঢুকলো না খোলা দরজা দিয়ে। স্বাধীন নিজের আশ মিটিয়ে আবার ঘুমের দেশে। রাজন্যার মনে পড়ে গেল ওর ট্রেনিং চলাকালীন আঠারো বছরের একটা মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল স্বামীর অতিরিক্ত আদরের জন্য। বিবাহিত বলেই ধর্ষণ বলা গেল না। আসলে আদরের নমুনায় বেচারিকে তিনটে সেলাই দিতে হয়েছিল। নার্সদিদিরা মেয়েটাকে অকথ্য গালিগালাজ করেছিল। তখনকার অবস্থা এখন হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে সে। যদিও খুব করুণ পরিণতি তার নয়, তবু যেন ঘটনাটির সাথে কোথাও একটা মিল খুঁজে পেল। সাবধানে পথ চলতে হবে, আবেগে ভাসা চলবে না।
-এরপর আগামী সপ্তাহে...
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ