ছুটি শেষে এবার রাজন্যা ফিরে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদে। বিয়ের পর থেকে স্বাধীন কিছুতেই বউকে কাছছাড়া করতে চাইছে না বলে তারও মনটা বেশ ভারি কিন্তু স্বাধীনকেও এবার অফিস জয়েন করতে হবে। বিয়ের পর রাজন্যার শরীর আর মন দুটোই বেশ চনমনে রয়েছে। প্রথম প্রথম স্বাধীনের আদর করার ধরণ অস্বাভাবিক লাগলেও এই কদিনে রাজন্যাকে সে সুখী করতে পেরেছে। শাশুড়িমার যত্নে সে বেশ তৃপ্ত। নাহ্ আর বুঝি কোন ঝড়ের আভাস নেই, নিশ্চয় এবার সে ভালো থাকতে পারবে। মুর্শিদাবাদের এই কর্মস্থল কেমন যেন মন খারাপের বীজ বুনে চলেছে। বিয়ের পর তো এই বীজ চারা থেকে বৃক্ষ হয়ে উঠছে। তবু তার ব্যবহার আর শ্রম দিয়ে সে প্রায় সকলের মন জয় করে করে নিয়েছে বলেই হয়তো পরিবেশটা থাকার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে সময় এগোয়, একদম কাউকে কোন সুযোগ না দিয়েই। বুঝলে ভালো, না বুঝলে সময় নষ্ট। এরমধ্যেই দুজন দুজনের ছুটির জন্য অপেক্ষা করে বছরটাও কাটিয়ে দেয় । বারকয়েক শ্বশুরবাড়ি আসা যাওয়া হয়েছে। শেষ বার বাড়ি এলে শাশুড়ি হাসতে হাসতেই বৌমাকে বলেছে-
-এবার নিশ্চয় তুমি তোমার মাইনের টাকা আমার হাতে তুলে দেবে..
-কেন মা? আমার সামান্য টাকা তো আপনার হাতের আঙুল দিয়ে গলে যাবে..
-কী বলতে চাইছো?
- বলছিলাম আপনি একাই এই পরিবারের বিশাল ব্যবসা সামলাচ্ছেন। টাকাকড়ি, সোনাদানা সবকিছুর মাঝে আমার কটা টাকা....
- ও এমনি বলছিলাম আর কী! মেয়ে হলে কি মায়ের হাতে তার মাইনেটা দিত না? তাছাড়া তোমাকে আমি মেয়ের জায়গা দিয়েছি।
-কিন্তু মা, ওটুকু টাকা দিয়ে আমি আপনাকে অসম্মান করতে পারবো না।
যার বেশি আছে, সে আরো বেশি চায় এটাই তো নিষ্ঠুর সত্য। স্বাধীনের বাবা স্বরাজবাবু অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও তার বউটির স্বভাব পরিবর্তন করতে পারেননি বলেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। স্বাধীন একেবারেই মায়ের কার্বন কপি। এরা যতই ভালোমানুষ হবার ভান করুক না কেন একসময় নিজেদের স্বভাব প্রকাশ করেই ছাড়বে। রাজন্যার জন্য তার দুঃখ হয়। একটা বছর কোনভাবে কেটে গেছে কিন্তু প্রতিটি দিন ভয়ে ভয়ে থেকেছেন এই বুঝি তিল থেকে তাল হয়। তিনি জানতেন রাজন্যা রোজগেরে বলেই তড়িঘড়ি বিয়েটা হয়ে গেল। এবার ওই বউকে নিজের দলে টানার চেষ্টা চলবে। সহজে কাজ হলে আর কথা বাড়বে না, না হলে তারা যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে! এদিকে নিজের চারছেলের কোনটিই ঠিকমত মানুষ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা তার ছেলেরা কখনও নিজের পরিবারকে নিজের বলে মনেই করেনি। এসবের জন্য তিনি অগাধ সম্পত্তিকেই দায়ি করেন আর দায়ি করেন তাদের মা'কে। অবান্তর প্রশ্রয়ে ছেলেগুলো অমানুষ হয়েছে এক একটা। কেউ কারো সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না, প্রয়োজন ছাড়া। এদের ব্যবহার রাজন্যার চোখ এড়ায়নি। এসব নিয়ে প্রশ্ন করার আগেই শাশুড়ি বলে দিয়েছেন কারো ব্যাপারে নাক গলানো বা কৌতুহল প্রকাশ করার দরকার নেই। এ বাড়ির সকলেই নিজের মত থাকতেই পছন্দ করে এবং কেউ যেন অহেতুক কাউকে বিব্রত না করে ।
রাজন্যা অনেক কষ্ট করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছে, তার নিজের স্বামীও যদি তার অবলম্বনের দিকে হাত বাড়ায়, তাহলেও এটা সে মেনে নেবে না। শাশুড়িমা তার ছেলের সামনেই কথা কটা বলেছে, স্বাধীন তার মাকেও কিছু বলেনি, রাজন্যার পক্ষও নেয়নি। রাজন্যা বুঝতে পারছে না স্বাধীন কী চায়! পরে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে সে বলেছে- "এটা তোমাদের দুজনের ব্যাপার। নিজেরাই মিটিয়ে নাও। আমি এর মধ্যে নেই"। এ ব্যাপারটা বাদ দিয়ে বাকি নিজেদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একদম ঠিকঠাক আছে। কিন্তু শাশুড়িমা থেমে নেই। সে আস্তে আস্তে নিজের স্বরূপ ধরছে। ইদানিং কিছু খেতে দিলে কেমন একটা ঝিমুনি অনুভব করে রাজন্যা। একদিন বিকেলবেলা ঠাকুরঘর থেকে একটা কিছু বাটার আওয়াজ কানে আসতেই ঠাকুরঘরে গিয়ে দেখে শাশুড়ি শেকড় জাতীয় কিছু একটা শিলে রেখে বেটে চলেছেন। কী এটা? চমকে উঠল রাজন্যা। সাথে সাথেই স্বাধীনকে ডেকে এনে দেখালো। রাজন্যা ধরে ফেলেছে এগুলো নিশ্চয় তার জন্য। স্বাধীন বিশ্বাস করে না। রাজন্যা ঠিক করে নিয়েছে আর এখানে একটা রাত নয়। স্বাধীন রাজন্যাকে বোঝানোর চেষ্টা করে- "এটা নিশ্চয় তোমার জন্য নয়, হয়তো মা'র অন্য কোন কাজে লাগবে। একবার জিজ্ঞেস তো করতে দাও.." রাজন্যা কোন কথা শুনতে চায় না। ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৎক্ষণাৎ বেরোবার সিদ্ধান্ত নেয়। বেগতিক দেখে সে রাজন্যাকে বলে- "অপেক্ষা করো আমিও তোমার সাথে থাকব, এ বাড়িতে নয়। তোমাকে আর একা ছাড়ব না"। স্বাধীনের কথায় রাজন্যার চোখের কোনে জল এসে যায়। মনে মনে হয়তো এটাই কামনা করেছিল।
চটজলদি ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্তে শাশুড়িমা অবাক হয়ে যায়। স্বাধীনকে বলে-
-তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-রাজন্যার সাথে।
-না, যাবে না। আমার নির্দেশ।
-আমি যাবো মা, এভাবে রানিকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।
-কিন্তু হঠাৎ চলে যাচ্ছো কেন?
এবার রাজন্যা উত্তর দেয়-
-ঘনঘন ছুটি পাবো না, তাছাড়া এখন কাজের চাপ বেড়েছে। আমার পক্ষে এখানে এসে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া দূরত্বও একটা বড় বাধা।
-কিন্তু বউমা তুমি বোধহয় রাগ করে চলে যাচ্ছো...
-না, না মা! আপনার উপর কিসের রাগ?
- তোমার মাইনের টাকাটা চেয়েছি বলে..
- সে তো আপনি হেসে হেসে বলেছেন, এটা তো আপনার মনের কথা নয়। তাহলে রাগ কিসের মা?
-বেশ, আমার কথা রাখো, থেকে যাও।
-বদলির অর্ডার না আসা পর্যন্ত আমায় ক্ষমা করবেন মা।
-ঠিক আছে। তবে কখন আসবে আগে থেকে জানিয়ো।
-হ্যাঁ, মা জানাবো।
সেদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল রাজন্যা। সে তার শাশুড়ির আসল রূপ দেখে ফেলেছে। না জানি কী ঘুরছে শাশুড়ির মাথায়। তবে চলে আসার সময় শ্বশুরের থমথমে মুখ দেখে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠেছিল। এ বাড়ির এই মানুষটিকেই একমাত্র স্বচ্ছ ও নিরীহ মনে হয়েছে। অন্যদিকে স্বরাজবাবু মনেমনে রাজন্যার প্রত্যুপন্নমতিত্বে খুশি হয়েছেন, চিন্তামুক্ত হয়েছেন। চোখের সামনে শাশুড়ির বৌমার নাট্যসংলাপে তিনি বউমাকে বাহবা দিয়েছেন, পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। এ যাত্রা হয়ত মেয়েটা বেঁচে গেল। তবে একটা সংশয় রয়ে গেল- সঙ্গে বিষ পিঁপড়ে নিয়ে যাচ্ছে, কামড় সহ্য করতে পারবে তো?
-এরপর আগামী সপ্তাহে.....
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ