ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি /রঙ্গনা পাল/ পর্ব -২৮ -
নামে মথুরাপুর, বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে যশনগরে। ঠিক আছে। অসুবিধে হবে না তেমন। রাজন্যা অল্পে তুষ্ট। এদিকে স্বাধীন মনে মনে ভীষণ খুশি, রাজন্যাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়ে যাচ্ছে। এখানে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো কামিনীর কামনাকে মান্যতা দেওয়া। কামিনী থাকে যশনগরে। নাটকের রঙচঙে নায়িকা! এরা জানে কেমন করে নাট্যদল পরিচালকের মাথা খেতে হয়। যশনগরের কামিনীকে ওই তল্লাটে সবাই চেনে। পুরুষের খিদে মেটানোর অব্যর্থ ওষুধ কামিনী। স্বাধীন মেয়েদের দেহ ছাড়া তেমন কিছু বোঝে না। যে মেয়ে তাকে অস্বীকার করে, তাকে বিছানায় না ফেলা পর্যন্ত সে থামে না। এই নিষ্ঠুর সত্যের নিদারুণ প্রমাণ দিয়েছে রাজন্যা। রাজন্যা স্বাধীনের আচরণে বারবার কষ্ট পেলেও ভালোবাসার খাতিরে অনেককিছুই মেনে নিয়েছে। সে আজও জানে না, স্বাধীন রাজন্যাকে কখনও ভালোবাসেনি, ব্যবহার করে আসছে মাত্র।
স্বাধীন চাকরিটা করে শখে, নিজের একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য। কাজের জায়গায় একনিষ্ঠ কর্মীর তকমা লাগিয়ে রেখেছে। আসল নেশা তো নাটকে। নায়কের চেহারা নিয়ে জন্মেছে, আচ্ছা আচ্ছা অভিনেত্রীরা স্বাধীনের অভিনয়ের প্রশংসায় এক ঢোক জল বেশি খায়। কেউ কেউ একটু বেশি গা এলিয়ে দেয়। স্বাধীন সুযোগ মতো তাদের কাজে লাগায়। কামিনী বুঝেছে খুব বেশি উড়তে দিলে স্বাধীন এমন লীলাকাশ তৈরি করবে যে আর কিছুদিন পর কামিনীই সেই আকাশে ওড়ার জায়গা পাবে না। তাই এখন থেকেই রাশ পরিয়ে রাখতে চাইছে, যাতে স্বাধীন তার লাগাম ছাড়া না হতে পারে। শেষ পর্যন্ত কামিনীর ইচ্ছেতেই স্বাধীন যশনগরে এসেছে। এখন তার আর স্বাধীনের অবাধ মেলামেশার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। স্বাধীন এতদিন অনেক নারীসঙ্গ করেছে ,আর না! এবার কামিনী-ই হবে স্বাধীনের জীবনে একমাত্র নারী। পৈশাচিক হাসি হাসল কামিনী।
রাজন্যার পেটের মধ্যে বাচ্চাটা যত বড় হচ্ছে, রাজন্যার অস্থিরতা ততই বাড়ছে। স্বাধীনের এতটুকু ফুরসত নেই রাজন্যার দিকে তাকাবার। তার সুখ-দুঃখ, সুবিধে-অসুবিধের ধার মাড়ায় না মোটে। অফিস-নাটক-কামিনী এর বাইরে তার জগতে আর কেউ নেই। এমন ভান করে যেন বাচ্চা পেটে আনারই দায় ছিল তার, দায়িত্ব নয়। নাহ্ একটা দিনের জন্য কোন দায়িত্ব নেয়নি। তার মধ্যে না বাবা হওয়ার সৌজন্য আছে আর না অর্থ যোগানের দায় আছে। শাড়ি জামা তো দূর একটা মেডিসিনের দায়িত্বটুকুও বহন করলো না। উল্টে বাড়িভাড়ার টাকাটাও তাকেই মেটাতে হয় সময়মতো। রাজন্যার ভেতরের অভিযোগের পাহাড় থেকে কী করে যেন ছোট্ট একটা নরম নদী-ই সমস্ত আপদ বিপদ সামলে জন্ম দিল একটা দেবশিশুর। কী গোলগাল নধর আর নটখটে! প্রাণ জুড়িয়ে গেল একেবারে। এই দেবশিশু-ই ধীরে ধীরে রাজন্যার পৃথিবী হয়ে উঠল। একটু একটু করে বাড়তে থাকল শিশুটি। তার খিলখিল হাসি আর দুষ্টুমির কান্না রাজন্যাকে এনে দিল স্বর্গীয় সুখ। ভালো ছিল খুব ভালো ছিল সে। কিন্তু হতভাগ্য যার সে কী সুখী হতে পারে কখনও?
কামিনীর কামখেলা আর মেনে নিল না পড়শীরা। দিনের পর দিন একটা মেয়েকে বঞ্চিত করে তার স্বামী অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে থাকবে এটা বড়ই দৃষ্টিকটু মনে হল। ক্লাবের সভাপতিকে ডেকে জানালো জনপ্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার পর স্থির হলো ক্লাবের সভাপতি রাজন্যাকে জানাবে তার স্বামীর কীর্তিকলাপের কথা। রাজন্যার ছেলে রাজর্ষি তখন সাড়ে তিন বছরের। ক্লাবের সভাপতি দয়ানিধিবাবু মেয়ের বয়সী রাজন্যাকে কীভাবে কথাটা বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তবু নিরীহ মেয়েটির কথা ভেবে তার স্বামীর সাথে এ পাড়ার কামিনীর দীর্ঘদিনের নষ্টামির কথা বললেন। তিনি আরও বললেন, রাজন্যা সহমত জানালে তারা ক্লাব থেকে পদক্ষেপ নিতে পারে, এও জানালেন পড়শীরাও তার সাথে আছে। রাজন্যার পায়ের তলার মাটি অনেকদিন আগেই সরেছে এবার পাড়ায় মুখ দেখাবে কী ভাবে, সেই চিন্তায় মগ্ন হলো। দয়ানিধিবাবু বোধহয় রাজন্যার অবস্থাটা আন্দাজ করতে পারলেন। তিনি বললেন -
-মা এতে তোমার লজ্জার কিছু নেই। যাদের লজ্জা পাবার কথা তারা তো বেহায়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি কেন উতলা হচ্ছো?
-এখন কী করি বলুন তো!
-তুমি আমাদের হাতে ছেড়ে দাও.. গণধোলাই দিয়ে তারপর থানা...
-না, না মেশোমশাই..উনি সরকারে চাকুরে। আমি চাই না ওঁর চাকরির ক্ষতি হোক।
-একটা অপরাধীকে বাঁচাচ্ছো?
- জানি আমি অপরাধ করছি তবু আজকাল একটা চাকরি পাওয়া ভীষণ কষ্টের আর আমি...
-তুমি সহ্য করলেও আমরা আর স্বাধীনকে এ পাড়ায় থাকতে দেব না..
-কটাদিন আমায় দেবেন? একটা শুধরোনোর চেষ্টা করি ..
-ঠিক আছে। এক সপ্তাহ সময় দিলাম।
-ধন্যবাদ। আমাকে কামিনীর ঠিকানাটা দেবেন?
- আমাদের ক্লাব পেরিয়ে একটা বাঙালপাড়া আছে। ওখানে গেলেই যে-কেউ কামিনীর ঘর দেখিয়ে দেবে।
ছেলেটার জন্য একটা আয়া রেখেছে রাজন্যা। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ির জড়িবুটি থেকে বাঁচতে চলে এসেছিল স্বাধীনের সাথে। কানাকানি শুনেছে একটা মেয়ের এ বাড়িতে যাতায়াত আছে। নিজে চোখে না দেখলেও স্বাধীনের রুম পরিস্কার করতে গিয়ে কখনও বিছানায় পারফিউমের গন্ধ, কখনও খোঁপার কাঁটা, কখনও ক্লিপ কখনও আবার পায়ের চুটকির সন্ধান পেয়েছে। এ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে স্বাধীন বলেছে এখানে অনেক মেয়ের যাতায়াত আছে। তারা সবাই নাট্যকর্মী। অত্যন্ত কড়া গলায় বলেছে, প্রাপ্ত বস্তু বিষয়ে দ্বিতীয় কথা যেন রাজন্যা না বলে। প্রয়োজনে তার রুম পরিস্কার করার দরকার নেই। সে যেমন নিজের ছেলে নিয়ে আছে তাই যেন থাকে। প্রায় চার বছর স্বাধীনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক নেই, বাচ্চাটা হবার পর স্বাধীন চাইলেও রাজন্যা চায়নি কোনরকম শারীরিক সম্পর্কে পুনরায় জড়াতে। আসলে স্বাধীনের সাথে সহবাসে তার রুচি নেই। তার জন্য কেবল ঘেন্না আর করুণা ছাড়া কোন অনুভূতি নেই। তবু স্বাধীনকে নরক থেকে বের করার একটা চেষ্টা করতেই হবে। অগত্যা খুঁজে খুঁজে এসে পৌঁছালো কামিনীর বাড়ি।
-এরপর আগামী সপ্তাহে......
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ