ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/রঙ্গনা পাল/ পর্ব- ২৯
ভালোবাসা সেই অর্থে কোনদিন জন্মায়নি, কৃতজ্ঞতায় কেনা পাহাড়ের নিচের জমিটা বহুবার আবাদ করতে চেয়েও বিফল হয়েছে। বোঝাপড়ার ফাটলটা এত বৃহৎ হয়ে গেছে কোনভাবেই মেরামত করার উপায় নেই। রইল বাকি অধিকারবোধ! কার উপর অধিকার দেখাবে যে ভোগের জন্য বিয়ে করে! একটা সম্পর্ক তৈরি করতে গেলে সবার প্রথম লাগে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ধার দিয়ে কখনও হাঁটেনি স্বাধীন। তবু কিসের যেন একটা টান থেকেই রাজন্যা বাঙাল পাড়া আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কী সেই টান? দয়া, মায়া নাকি কর্তব্য? কীসের কর্তব্য? কার প্রতি? সত্যই কী সে স্বামী পদবাচ্য? অনেকক্ষণ থেকেই কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজন্যার। বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি। গনধোলাই থেকে বাঁচাবার-ই বা কী প্রয়োজন। জনগণের হাতে মার-ই চরিত্রহীনদের অব্যর্থ ওষুধ! তবে যদি শিক্ষা হয়!
মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে বলেই বুঝতে পারেনি বাঙালপাড়া এসে গেছে। সামান্য খোঁজ করতেই কামিনীর বাড়ি এসে গেলো। দরজাটা খোলা ছিলো তবু কড়া ধরে কয়েকবার নাড়া দিতেই এক মহিলা বেরিয়ে এলো। মহিলা তার বয়সী। গায়ের রঙ খুব ফর্সা বা কালো না। দাঁত উঁচু, পুরু ঠোঁট, লম্বা নাক হলেও মুখশ্রীতে আগলা সৌন্দর্য আছে। মহিলাটি শাড়ি পরে আছে তবে কাপড়টা বুক থেকে সরে গিয়ে খোলা বুক ঠিকরে বেরিয়ে আসছে উন্নত পয়োধর। রাজন্যা মেয়ে হয়েও চোখ সরাতে পারছে না.... মহিলা প্রশ্ন করলো-
-কাকে চাই? হুট করে ঘরে ঢুকে পড়লেন কেন?
-এটা কি কামিনীর বাড়ি? আমি তার খোঁজেই এসেছি।
-কেন বলুন তো? আপনি কি নাটকে রোল চান নাকি? না না...হবে না...ভাগুন তো..
-আরে আপনি এরকম ব্যবহার করছেন কেন?
-এই ফুটুন তো...নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছেন কোনদিন?
-আপনি কামিনীকে ডাকুন, তার সাথে আমার কথা আছে।
-এখানে কোন কামিনী থাকে না।
কথাটা শোনা মাত্র রাজন্যা ওই মহিলাকে সরিয়ে জোর করে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।
ভেতরে ঢুকে তেমন কাউকে দেখতে পেলো না। শুনছেন, শুনছেন, কেউ আছেন? বলে চিৎকার করতেই এক ভদ্রলোক ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ওদিকে ওই মহিলাও খানিক বেকায়দায় পড়লো মনে হলো। ভদ্রলোক বললেন-
-কাকে চাইছেন?
-কামিনীকে।
-ওই তো কামিনী। আমার মেয়ে।
বলেই তর্জনী উঁচিয়ে পিছনে দাঁড়ানো ওই মহিলাকে দেখালেন। রাজন্যা এবার কামিনীর দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি বলল -
-অসভ্য মেয়ে একটা। নোংরামির চূড়ামণি!
-চু.....প্
-কেন চুপ করবো? দিনের পর দিন স্বাধীনের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছিস..মুখে বড় বড় কথা বলিস কীভাবে? অবশ্য বাড়িতে আসা ইস্তক যা আচরণ দেখছি, তাতে তোর চরিত্র বুঝতে বাকি নেই।
খবড়দার...আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই অপমান করছিস? আমি কোন স্বাধীনকে চিনি না.....এই মুহূর্তে দূর হয়ে যা এখান থেকে.....
আগন্তুক মহিলার মুখে এ কী শুনছেন ! ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে গেলেন। মেয়ে নাটক করার জন্য অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরে থাকে। এ নিয়ে পাড়ার লোক কথা শোনায় কমবেশি। সেগুলো হজম হয়ে গেছে। কিন্তু যেভাবে এই মহিলা তার মেয়েকে আক্রমন করলো তাতে তার মেয়েকে নিয়ে বড়সড় সন্দেহ দানা বাঁধছে। এখন কীভাবে পুরো ঘটনাটা জানবেন সেটা নিয়ে বেশ উদ্বেগে রয়েছেন। রাজন্যা কামিনীকে আর কোন কথা না বলে গতদিনে ক্লাবের সভাপতি দয়ানিধিবাবুর বলা কথাগুলো হুবহু বলে গেলেন কামিনীর বাবাকে। ভদ্রলোক কথাগুলো শুনে কেমন থ হয়ে গেলেন। একমাত্র মেয়ে কামিনীকে লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিকা বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। পড়াশোনায় দারুণ ভালো ছিল সে। কোন্ কুক্ষণে পড়াশোনা ছেড়ে যে এই মেয়ে নিজের সর্বনাশ করে বসলো!!! মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ভদ্রলোক। মুখ দিয়ে আর কোন কথা বলছেন না। রাজন্যাও খানিকটা ভয় পেয়ে গেল ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে।
বাবার কাছে এই মহিলা যেভাবে তাকে ছোট করলো, তাতে রাগে দিগ্বিদিক হারিয়ে রাজন্যার উদ্দেশ্যে বলেই ফেললো- "তোকে যদি স্বাধীনের জীবন থেকে না সরিয়েছি তো আমার নাম কামিনী নয়..." রাজন্যা শিউরে উঠলো। এই মেয়ের এতটা সাহস হয় কী করে! নিশ্চয় ওরা নিজেদের অনেক গভীরে নিয়ে গেছে। আজ অবধি রাজন্যা স্বাধীনের উপর এতটা জোর দেখাতে পারেনি, আর এই মেয়ে অবৈধ একটা সম্পর্কে থেকে এতটা শাসাচ্ছে? পায়ে পায়ে বাইরে এসে বাইরের খোলা হাওয়ায় খানিকটা অস্বস্তি কাটিয়ে ভাড়াবাড়িতে ফিরে এলো । ছোট্ট রাজর্ষিকে জড়িয়ে অনেক করে বললো- "জানি না বাবা, তোকে নিয়ে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে কী না! তোর ঠাম্মির কাছে যেতে পারবো না, সে তো তোর খোঁজ নেয় না, মুখেভাতের অনুষ্ঠানটাও করেনি। তোর বাবা তোকে কখনও তেমনভাবে আদর করেনি, তোর সাথে সময় কাটায়নি। তাই এখানে থাকার কোন মানে হয় না। আসন্ন যে বিপদের আঁচ পাচ্ছি, সেই বিপদের আগুনে পুড়ে যাবো কী না জানি না। যদি বেঁচে যাই তাহলে তোকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। সম্ভব হলে এবার নিজের সামর্থে একটা বাড়ি বানাবো।" ছোট্ট ছেলেটা না বুঝেই কেমন মড়া কান্নার মতোই কাঁদতে থাকলো। কিছুতেই ছেলেটাকে থামানো যাচ্ছে না। তবে কী বিপদ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে?
দিনের শেষে কালসন্ধ্যা এলো। সাথে এলো কাল। কামিনী আর স্বাধীন দুজনেই উপস্থিত হলো রাজন্যার সামনে। কোন ভণিতা না করেই স্বাধীন বলে-
-কার প্ররোচনায় কামিনীকে অপমান করেছো?
-ও অপরাধ করেছে, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছি।
-পা ধরে ক্ষমা চাও, ওর কাছে।
-অসম্ভব... তুমি একটা ক্লীব তাই আমাকে ওর কাছে ক্ষমা চাইতে বলছো।
-কামিনীর অপমান আমি সহ্য করবো না....
-কী করবে তুমি? গণধোলাই খাবে?
-এতো সাহস তোমার... খুব বাড় বেড়েছে না?
রাজন্যা কিছু বলতে যাবার আগেই ওর বাম গালে স্বাধীন গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল। রাজন্যার বাঁদিকের কানের দুল কান থেকে বেরিয়ে কোথাও একটা পড়ে গেল। কানটায় তালা লেগে গেল। মাথা ঘুরে ঘরের মেঝেয় পড়ে গেল সে। ছেলেটার কান্না শূন্যে মিলিয়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
-এরপর আগামী সপ্তাহে......
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ