যশনগরের ভাড়াবাড়ি থেকে উঠে যাবার জন্য জিনিসপত্র গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে। এক বিশ্বস্ত বন্ধু বিপুল মাধবপুরে একটা ফ্ল্যাট দেখে দিয়েছে। গিয়ে দেখেও এসেছে। মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। বুক করা হয়ে গেছে। আর ক'য়েকদিনের মধ্যেই সেখানে গিয়ে উঠবে রাজন্যা। রাজন্যার আসার পর স্বাধীন আর আসেনি। অনুপমের সাথে গিয়ে ডঃ ভৌমিকের সাথে কনসাল্ট হবার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছে। বেশ কিছু মেডিসিন নিতে হচ্ছে। ছেলের উপর খানিক মন দিতে পারছে এখন। বাবা থেকেও নেই তাই ছেলের প্রতি একটু বেশি কেয়ার দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ছেলের মধ্যেও কেমন একটা ভীত সন্ত্রস্ত ভাব। কিছুতেই সহজভাবে চলাফেরা, কথাবলা কোনটাই পারছে না। এই চাকরিটা ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে সে। তাহলে চলবে বা কীভাবে! মাধবপুরে যাবার ঠিক আগের দিন শাশুড়ি এসে হাজির। এসেই রাজন্যার হাত দুটো ধরে বলে-
-তুমি তো আমার বৌমা নও, মা। তোমাকে আর দাদুভাইকে আমি নিতে এসেছি। আমার অপদার্থ ছেলেটাকে আমি ঘর থেকে দূর করে দেব। হতচ্ছাড়া ছেলে সব শেষ করে ছাড়লো..
-না, মা। ও বাড়িতে আমি আর ফিরবো না।
-ওকথা মুখেও এনো না ..যমের মুখ থেকে তোমাকে ফিরিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর। এতদিন শয্যাগত ছিলাম, তাই আমার এই মেয়েটাকে দেখতে আসতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করতে পারবে না মা?
-এসব কী বলছেন মা!
-সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করো।
- তা হয় না মা... আপনার ছেলে আমাকে চায় না...
-চায় না বললেই আমি মেনে নেব? দাদুভাই-এর ওপর আমাদের অধিকার তুমি অস্বীকার করতে পারবে না আর স্বাধীনকে তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও। ওকে শায়েস্তা করার ভার আমি নিলাম।
-কোন দরকার নেই। ও ওর নিজের মত থাক।
অনেক অপরাধ করেছি তাই তো বিছানাগত হয়ে পড়েছিলাম, এবার আমায় প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ দাও মা.....
মায়ের কাছে সন্তানের জোর খাটে না কোনকালে। সেই আগের দেখা মায়ের স্নেহ ফিরে পেতেই চোখে জল এসে গেল রাজন্যার। নাটুকে শাশুড়ি মনে মনে সাফল্যের হাসি হাসে। ছেলেকে দেওয়া কথা তাকে তো রাখতে হবে।
মাধবপুরের ফ্ল্যাট ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে শাশুড়ির সাথে শ্বশুরবাড়ির পথে পা বাড়ায় রাজন্যা। যাক্ শাশুড়ি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই তার কাছে বড় প্রাপ্তি। তাছাড়া রাজর্ষিটাও দাদাই ঠাম্মিকে পাবে। রাজন্যা চাকরিটাও মন দিয়ে করতে পারবে। আবার ভাবনার জালে নিজেকে জড়িয়ে নতুন করে ঘর বাঁধার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। ইসস্! মাধবপুরের ফ্ল্যাটের জন্য শুধু শুধু এত্তোগুলো টাকা খরচ করে ফেললো। সবেতেই বড় তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তা হোক! নিজের একটা বাড়ি থাকাও জরুরি । সোনাদানা থেকে এই বা কম কিসে! পড়ে থাক্...সময়শিরে না হয় যাওয়া যাবে... অনেকগুলো দিন কিভাবে যেন নষ্ট হয়ে গেল। নাহ্! এবার কাজে মন দিতে হবে। ছেলেটাকেও ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। দূর... সাতপাঁচ ভেবে মাথাটা খারাপ না হয়...মনে মনে বিড়বিড় করা থামিয়ে শাশুড়িকে অনুসরণ করে শ্বশুরবাড়ি এসে পড়লো। শ্বশুরমশাই রাজন্যাকে দেখে প্রথমটায় ভীষণ আনন্দ প্রকাশ করলেন, রাজর্ষিকে জড়িয়ে ধরলেন পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। তাঁর মুখে অন্ধকারের ছায়া দেখলো রাজন্যা। এর কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই শাশুড়ি তাকে ঘরে গিয়ে রেস্ট নিতে বলেন। রাজন্যা সিঁড়ি দিয়ে উঠে তার ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ানোর আগেই শাশুড়ি বলেন - "এখন থেকে তুমি একতলার ঘরেই থেকো দাদুভাইকে নিয়ে, উপরের ওই ঘরে যেতে হবে না।" আশ্চর্য হলেও রাজন্যা মনে মনে ভাবলো ভালোই হয়েছে, ওই ঘরে তার না যাওয়াই উচিত। শাশুড়ি হয়তো তার ভালোর জন্যই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো, শ্বশুরমশাই-এর মুখ কালো হলো কেন? উনি কি রাজন্যার ফিরে আসাতে খুশি হননি? বরাবর নিঃশব্দে থেকে এই একটি মানুষ-ই তার মঙ্গল চেয়ে এসেছেন। তাহলে? আজ কী হলো? ঘুরে ফিরে সেই মানসিক টেনশন! এক বিপদ কাটতে না কাটতেই আবার বিপদের আশঙ্কা। শাশুড়িকে বিশ্বাস করে আবার ঠকবে না তো? ছেলেটাকে রেখে বাইরে বেরোলে এরা ছেলেটার কোন ক্ষতি করে দেবে না তো? ঠাম্মি তো রাজর্ষির সাথে ভালো ব্যবহার করছেন রাজর্ষির বরং আড়ষ্ঠতা কাটেনি। নিজের ঠাম্মি তবু কেন যে ছেলেটার জড়তা কাটছে না কে জানে! রাজন্যা না হয় পরের মেয়ে, রাজর্ষি তো ওদের আপন রক্ত। এই বয়সের ছেলেরা বেশ ছটফটে হয় রাজর্ষিটা একদম চুপচাপ। হবে না বা কেন? ছোট থেকে কারো আদর পায়নি, অবহেলা, হেলাফেলায় পরিচারিকার কাছে বড় হয়েছে। বাবা থাকলেও কখনও তেমনভাবে আদর করেনি বা ভালোবাসেনি। হয়তো চুপচাপ থাকা ওর অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে।
মাঝরাতে চুপিচুপি স্বাধীন এলো। মা সন্তর্পণে দরজা খুলে দিতেই সে সটান উপরে নিজের ঘরে চলে গেল। একটু পরে মা হাজির। রাত যত অন্ধকারকে গাঢ় করে মা ছেলের পরামর্শ ততই গভীরত্ব প্রাপ্ত হয়। ছেলেকে বলে, "তুই চালিয়ে যা, আমি তোর বউকে দেখাবো নরকযন্ত্রণা কাকে বলে। আজ ওর জন্য তোকে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি আসতে হচ্ছে। দিনের আলোয় গা ঢাকা দিতে হচ্ছে। সমাজের কাছে মাথাটা মুড়িয়ে গেছে। এর বদলা নিয়েই ছাড়বো। পাগলাগারদ হবে ওর আসল থাকার জায়গা। ছেলেটাও ওর মায়ের পথেই হাঁটবে দেখিস।"
---এরপর আগামী সপ্তাহে....
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ