কুন্তল দেশমুখ মৃদুলদার বন্ধু, একই সাথে শিক্ষকতা করে। অনেক ছোটোবেলা থেকেই আলাপ। মনে মনে রাজন্যাকে ভালোবাসে, বলতে পারেনি আজও। রাজন্যা যখন স্কুলের গণ্ডি শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল তখন কুন্তল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নবীন বরণের গোলাপ দিতে গিয়ে হাতের আঙুলে কাঁটা ফুটে গিয়ে সে কী কাণ্ড! সাথে সাথে আঙুলটা মুখে নিয়ে রাজন্যা রক্ত পড়া বন্ধ করেছিল। এটা নিয়ে কলেজে খুব টিটকিরি সহ্য করেছে কুন্তল। রাজন্যা এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তার কিছুদিনের মধ্যে নার্সিং-এ সুযোগ পেয়ে চলে এসেছিল। ফলে না তো কুন্তল কিছু বলার সুযোগ পেয়েছে, না রাজন্যার সান্নিধ্য পেয়েছে। রাজন্যা বোঝেনি এমন নয়, তবে ভালোবাসা তার জীবনে কেবল ভুল ছাড়া আর কিছু না। প্রণয়কে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল কিন্তু প্রণয় না বুঝে তাকে দূরে ছুড়ে ফেলেছে। পরে যখন ফিরেছে তখন স্বাধীনকে অলিখিত কথা দিয়ে ফেলেছে। আর এখন তো জীবনটা নরককুণ্ড হয়ে আছে। আদৌ স্বাধীনের থেকে মুক্তি পাবে, নাকি পরাধীনতার সম্পর্কঘুড়িতে জীবনটা ভাসমান অবস্থায় রয়ে যাবে কে জানে! কুন্তলদাকে দেখে রাজন্যার মনে হলো বিশেষ পরিচিত কারো দেখা পেলো। আত্মীয় স্বজন, মা বাবা বা নিকট সম্পর্কের মাধুর্য সে কখনও লালল করতে পারেনি তাই পরিচিত কোন মানুষ দেখলে মনের শাখে কোরক আসে। কুন্তলদার সাথে ওই অপরিচিতাকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে খানিকটা বিস্মিত হয়নি এমন নয়। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো সে তার স্ত্রী। পরে কিছু কথাবার্তা কানে আসায় বুঝেছে সে অন্য কেউ। ফোন নং আর ঠিকানা দিয়েছে, যোগাযোগ করবে নিশ্চয়।
অনেক বছরের ব্যবধানে রাজন্যাকে দেখলো কুন্তল। সেদিনের কাঁটা এখনও ফুল হয়ে ফুটে আছে। বিয়ে করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। রাজন্যার পর আর কারো দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনি অথবা তাকাবার সময় পায়নি। রাজন্যা চলে যাবার পর তার জীবনেও ঝড় বয়ে গেছে। বাবা মারা গেলেন হার্ট আ্যাটাক-এ। তিনি প্রাইভেট জব করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব বাড়তে থাকলো। নিজে টিউশনি করে সংসার চালিয়েছে, সাথে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। যা কিছু সম্বল ছিল তার মধ্যে কষ্ট করে কোনোমতে বোনের বিয়ে দিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা একটু একটু করে ভেঙে পড়েছেন। সংসারের কাজে মা'কে সাহায্য করতে হতো। এমনকি রান্নাটাও করতে হয়েছে। বোনের বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তার বর একটা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। শ্বশুরবাড়িতে বোনকে অপয়া আখ্যা দেবার পর কুন্তল নিজে গিয়ে চার বছরের ভাগ্নি সহ বোনকে এনে নিজের কাছে রেখেছে। মা শোকে পাথর হয়ে আছেন। এদের নিয়ে কুন্তলের কেটে যায় কোনোমতে। স্কুলের চাকরিটা পাবার পর এখন সংসারে খানিক স্থিতি এসেছে। এতো তাড়াতাড়ি বছরগুলো পেরিয়ে গেছে বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি। টুকটাক লেখালেখি করে সময় পেরিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে এখানে ওখানে সাহিত্য সভায় যোগ দেয়, এতে মন ভালো থাকে।
রাজন্যা দেখতে কালো ছিলো বটে তবে তার মুখশ্রীর সৌন্দর্য ছিল শান্ত কমলদিঘির মতো। আজ কেমন বিদ্ধস্ত লাগছিল। সেই শ্রী আর নেই। একটা মনকেমন বুকের কাছে দলা পাকাচ্ছে। ও কী ভালো নেই? সুপ্রীতি ম্যাডামকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ইতস্তত ভাবনাগুলোতে জাপটে যাচ্ছে ক্রমশ। শুনেছিল মস্ত বাড়ির বউ হয়েছে। বর সরকারি চাকুরে। অগাধ সম্পত্তি তাদের। তাহলে? সুপ্রীতি ম্যাডাম না থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করতো। আচ্ছা এখন কি একবার ফোন করবে? না, না..সে কী ভাববে। এই তো দেখা হলো। আবার ভাবছে ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিয়েছে একবার কি দেখা করবে কাল? একটা দিন বাড়তি থেকে গিয়ে রাজন্যার খোঁজ নেবে? সে কি একটু বেশি কৌতূহল প্রকাশ করে ফেলছে? তার এই বাড়তি আগ্রহে যদি রাজন্যার সংসারে কোন ঝামেলার সূত্রপাত হয়! না না তা কেন! রাজন্যার সমস্যা থাকলে সে তার ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানাতো না। আপাতত কুন্তল মনস্থির করলো প্রথমে ফোন করবে তারপর দেখা করবে। একবার যখন ঈশ্বর তাদের দেখা করিয়েছেন তখন সমস্ত খোঁজ নিয়েই ফিরবে।
কেনাকাটা করে ফ্ল্যাটে ফিরে রাজর্ষিকে নিয়ে এসে মা ছেলেতে খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে রান্নাঘরে গেল রাজন্যা। কুন্তলদার সম্বন্ধে আগ্রহ বাড়ছে। নিজেকে দূষছে সে, কেন যে সে ফোন নম্বরটা নিলো না। সেই তো ফোন করে নিতে পারতো। তাহলে ভাবনাটা বাড়তো না। অবশ্য কুন্তলদা রাজন্যার খোঁজ নেবেই বা কেনো, সে নিশ্চয় তার নিজের সংসারে সুখী আছে। মুখ দেখে তো তেমন কিছু আন্দাজ করতে পারেনি, আগের চেয়ে এখন সে অনেকটা স্মার্ট হয়েছে। শরীরে একটু মেদ জমেছে। এতটাই লক্ষ্য করতে পেরেছে এর বেশিকিছু না। দূর বাবা...তখন থেকে কী সব ভেবে চলেছে। কাল থেকে তেমন কিছু পেটে পড়েনি। আজ ভালো করে রান্না করে খেয়ে দেয়ে বেরোতে হবে কাজের মেয়ে আর রান্নার মেয়ের সন্ধানে। ইতিমধ্যে একটার খোঁজ আছে, ওকেই পাকড়াও করতে হবে। নিজে বাঁচতে হবে, ছেলেটাকেও বাঁচবার জন্য অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে।
স্নান খাওয়া কমপ্লিট করে সবে ছেলেকে নিয়ে শুয়েছে এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো। এই অসময়ে কে এলো? জঞ্জালগুলোর কেউ নয় তো! হয়তো ওরাই! উফ্! শান্তি নেই । উঠে দরজা খুলতেই দেখে একটি মধ্যবয়সী মহিলা। বেশ ফিটফাট। পোশাক পরিচ্ছদেও বেশ রুচি আছে।
-ঠিক বুঝতে পারছি না তো, কে?
-আমি রেণুকা।
-এখানে কেন?
-পাশের ফ্ল্যাটের দিদি বললো আপনার কাজের লোক দরকার।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ... কিন্তু....
রেণুকা বুঝতে পারলো তাকে দেখে ম্যাডাম কাজের মেয়ে ভাবতে পারছেন না। বয়সে রেণুকা বড় হবে। সে বললো-
-হ্যাঁ, আমি বাড়ি বাড়ি কাজ করে খাই। স্বামী পরিত্যক্তা। তবে নিজেকে অবহেলা করি না।
-আমার সবসময়ের থাকার জন্য হলে ভালো হতো। এতে যত লাগে না হয় দেবো। কাজের চেয়ে বেশি ছেলেটার দেখাশোনা করতে হবে।
কাজের মেয়ের সাথে স্বাধীনের রাত কাটানোর কথা নিমেষে মনে পড়ে গেলো। অতীত স্মৃতি পিছু ছাড়ে না। কাজের মেয়ে রাখতে এখন অবশ্য বাধা নেই। এরকম শক্তপোক্ত মহিলা হলে তো ভালোই হয়। রেণুকার সমস্ত সোজাসাপ্টা কথায় খুশি হলো রাজন্যা। রেণুকা ঠাঁই পেলো রাজন্যার কাছে।
-----এরপর আগামী সপ্তাহে......
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ