ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি / রঙ্গনা পাল
রূপসার কথা শুনে রাজন্যার মনে রূপসার প্রতি আন্তরিকতা জন্মায়। কিন্তু তার কতটুকু বা ক্ষমতা। সদ্য জয়েন করার পরই এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ভাবেনি। রূপসা রাজন্যাকে দেখলেই কেমন কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। রাজন্যাকে দেখেই রূপসা বলে-
-আমাকে এখান থেকে মুক্তি দিন আন্টি
-আমি সদ্য জয়েন করেছি, তেমনভাবে কিছুই চিনি না, তবু তোমার কথা আমি ডেপুটি সুপার ম্যামকে বলে দেখবো।
-না, না আন্টি এখানে থাকলে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো।
-তুমি বুঝতে পারছো না, আমি তোমার জন্য এই মুহূর্তে কিছুই করতে পারবো না।
-পারবেন, আপনিই পারবেন।
-কী পারি বলো-
-দিদার ফোন নাম্বার দিচ্ছি, কথা বলুন।
-কী কথা বলবো?
-বলুন রূপসা আর নেশা করবে না, ভালো হয়ে যাবে, মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। আর বলুন আপনি এর গ্যারান্টি দিচ্ছেন।
-আর যদি তুমি ভালো না হও, তাহলে আমি বিপদে পড়ে যাবো। আমার চাকরিও চলে যেতে পারে।
-আমি সত্যি ভালো হয়ে যাবো আন্টি। আমি কখনও আপনাকে বিপদে ফেলতে পারি না।
রাজন্যা ভাবছে, চুলে জটা দেখেই কি রূপসা তাকে এতটা ভরসা করছে? যে কারণেই হোক রূপসা তার থেকে সাহায্য চেয়েছে। অতএব ওর ভালো থাকার একটা চেষ্টা তো করতেই হবে। মানছে রূপসা অপরাধ করেছে, কিন্তু সে তো আর সত্যি মেন্টাল নয়। সমাজের মূল স্রোতে ফেরার অধিকার তার আছে। একটা কিন্তু অবশ্য থেকে যাচ্ছে রূপসা ভালো হবে তো! নাহ্..একটা ঝুঁকি নিতেই হবে। আজ-ই রূপসার দিদার সাথে কথা বলবে সে। এই কদিনে মেন্টাল পেশেন্টরা ওর যে অবস্থা করেছে, তাতেই ওর নেশা ছুটে গেছে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রূপসার দিদার সাথে কথা বলে ডেপুটি সুপারকে ম্যানেজ করে রূপসাকে সত্যি মেন্টাল হাসপাতাল থেকে ওর দিদার বাড়িতে ফিরিয়ে দিল রাজন্যা। রূপসার দিদা প্রথমটা মানতে চায়নি, কারণ বিগত দিনে নেশাখোর রূপসার আচরণ দিদার বুকে দগদগে ক্ষতের মতো হয়ে আছে। সেই দগদগে ক্ষতে গ্যারেন্টির মলম লাগিয়ে রাজন্যা সত্যিই অসাধ্য সাধন করলো।
রূপসার এই কাজে উপর মহল খুব খুশি। কারণ রূপসাকে ওর দিদা নিজে এসে নিয়ে গেছেন। ডেপুটি সুপার ম্যামও খুব ভালো এবং বেশ মিশুকে। একদিন রাজন্যাকে বললেন-
-তুমি এবার চুলের জটা কেটে ফেলো
-না ম্যাম তা হয় না। আমার শিববাবা রুষ্ট হবেন।
-আর তুমিই যদি না বাঁচো..
-মানে?
-মানে এই ওয়ার্ডগুলোতে ঘুরে ঘুরে তো সমাজসেবা করে বেড়াচ্ছো, জানো কি এদের এখানে উকুন আর ছারপোকার প্রাচুর্যের কথা? একবার যদি তোমার চুলের জটায় প্রবেশ করে....
-এ তো ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা বলছেন ম্যাম!
-একদম সত্য বললাম, পরখ করেই দেখো...রেখে দাও জটা..
-কর্ম আমায় করতেই হবে ম্যাম। চাকরি ছাড়লে খাবো কী!
অগত্যা তড়িঘড়ি রাজন্যাকে আসতে হলো বিউটি পার্লারে। যদিও বিউটি পার্লারের কেউই রাজন্যার চুলের জটা কাটতে রাজি হলো না। তাদের বক্তব্য এর আগে এই ধরণের জটা কেটে তাদের চরম সর্বনাশের সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুকনো মুখে জটা নিয়ে ডেপুটি ম্যামের কাছে হাজির হলো রাজন্যা। ম্যাম নিজে রাজন্যার মাথার জটা কেটে রাজন্যাকে উকুন আর ছারপোকার হাত থেকে মুক্ত করলেন। প্রয়োজনে ওয়ার্ডের মেয়েদের চুলেও কাঁচি ধরেন ম্যাম। মোটামুটি অভ্যেস আছে। রাজন্যার চুলে নতুন ধরণের ছাঁট দিয়ে একদম বয়সের ভার কমিয়ে ফেললেন। বয়কার্টে দারুণ মানিয়েছে রাজন্যাকে। বাড়ি ফিরলে মা'কে নতুনভাবে পেয়ে রাজর্ষিও দারুণ খুশি। দিদিকে পুরোপুরি আলাদারকম পেয়ে রেণুকা ও খুব খুশি। ফ্ল্যাটে খুশির বাতাবরণ।
রাত্রে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না রাজন্যা। আজ আর এক মেন্টাল পেশেন্ট তাকে হাত নেড়ে ডেকেছিল। কাছে যাবার পর সেলের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে তার মাথার উপর থেকে একটা কুটো ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলো। রাজন্যা আবিষ্কার করে তার মাথার উপর কিছু একটা ছিল , যা ওই মেয়েটি সরিয়ে দিল। মেয়েটির পেটে সাত মাসের বাচ্চা। মেয়েটি সব ভুলে গেছে। রাজন্যা খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই মেয়েটিকে কারা গণধর্ষণ করে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে যায়। মেয়েটি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, আজ এই প্যাভলভের খাঁচায়। ওর কষ্টে রাজন্যা ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়েছে। ওর তো এই একটিই ঠিকানা, আজীবন এখানেই কাটাতে হবে। এখানে জয়েন করার পর রাজন্যা এটা উপলব্ধি করেছে, এখানে যারা আসে তারা কতটা অসহায়। এদের জন্য রাজন্যার অন্তর কাঁদে। নিজের কোন দুঃখ আর তাকে পীড়িত করতে পারে না। প্যাভলভের সমস্ত মেন্টালদের প্রতি রাজন্যার সহমর্মিতা তাকে সকলের প্রিয় করে তুলেছে। ওদের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। নতুন করে এদের জন্য অনেক অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে।
প্যাভলভে মেল ফিমেল ওয়ার্ড নির্বিশেষে রাজন্যা সকল পেশেন্টকে সমদৃষ্টিতে দেখে। যদিও ইদানিং শিশিরের একটা হিল্লে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সে। আর যাই হোক শিশির মেন্টাল নয়, তাকে মেন্টাল করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। ঘটনাটার আঁচ দিয়েছে শিশির নিজে। এটা কিছুতেই হতে দেবে না রাজন্যা। তার জন্য সামনে এক প্রশস্ত ময়দানে লড়াই করতে হলেও সে পিছিয়ে আসবে না। ছোট থেকে যে বাবামায়ের কোলে পিঠে বড় হয়েছে সেই শিশির, হঠাৎ জানতে পারে তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। এবং দত্তকপুত্রের উপর একটা সময় তার পালিত বাবা মা'র প্রচণ্ড নির্যাতন শুরু হয়। এমনকি শিশিরের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
-এরপর আগামী সপ্তাহে.....
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ