Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

শনি রবির সাহিত্য বাসর: ধারাবাহিক উপন্যাস-ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি-পর্ব ৪ /রঙ্গনা পাল




ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি-পর্ব ৪ 

   খুব কম বয়সেই রাজন্যা বুঝে গেছে সব মানুষ তার মা বাবার মতো না; কিছু ভালো মানুষ আছে বলেই এই পৃথিবীতে রূপ রস রঙ এখনও ভীষণ ভাবে রয়ে গেছে। তা না হলে যখন যখন তার মন খারাপ হয়েছে, সে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে ঠিক তখন তখন অন্য দিক থেকে ঠিক কেউ না কেউ কোন না কোন ভাবে তার মনের বিষণ্ণতা দূর করে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন এমন দিন তার জীবনে এসেছে যেদিন হাত থেকে একটা পাতি কাপ ভাঙলেও চোখের জল ভাতের গ্রাসের সাথে উদরস্থ করতে হয়েছে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে সামান্য দেরি হলে সারারাত তীব্র গরমে গুমোট ঘরে বিনা পাখায় থাকতে হয়েছে আবার ভাইবোনের অন্যায় আবদার মেটাতে না পারলে, মাথার চুলগুলো সিকিভাগ তুলে নেওয়া হয়েছে। তবু কখনো প্রণয়, কখনো মৃদুলদা আর বেশিরভাগ সময়ে বিশেষ করে ঘরে থাকলে দক্ষিণের জানালা আর বাইরে বেরোলে ছুঁয়ে যাওয়া প্রকৃতির প্রেরণায় রাজন্যা এখনো প্রাণের স্পন্দন নিয়ে বেঁচে আছে।

      ডুবন্ত ভাবনার দুনিয়ায় কখন যে আঁখি পল্লবে তন্দ্রা নেমে এসেছে ঠাহর করেনি রাজন্যা। অবশ্য খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো তার। দক্ষিণের জানালাটার দ্বার উন্মুক্ত করে চোখ দুটো মেলে দিলো সুপ্তোত্থিত সবুজাভ বনানীর গায়ে। বড় আরাম পায় নীরব চাওয়া পাওয়ায়। এখনো ভোরের আলো ফোটেনি হয়তো তাই ভাবনার ঘোর ঘুমোনোর পরেও ক্রিয়া করে চলেছে। আজ রথযাত্রা! জগন্নাথ রথে চড়ে নগর পরিক্রমা করবেন। 'জয় জগন্নাথ' বলে কপালে হাত ঠেকালো একবার। এতটাই পরাধীনতার শেকলে বাঁধা আছে যে , সে জানে না আজকের দিন তার কেমন কাটবে, হয়তো কেউই বলতে পারেন না তার নিশ্চিন্তে দিন গুজরানের কথা! সেক্ষেত্রে অন্তত একটা দিন ভালো ভাবে কাটানোর পরিকল্পনা করার অধিকার প্রায় সবার থাকে, নেই শুধু রাজন্যার। জন্মটাই বোধহয় মঘা নক্ষত্রে। তবু জগন্নাথের স্মরণে সে মনে মনে চাইছে দিনটা নির্বিঘ্নে কাটাতে। মনের জলতরঙ্গে প্রণয় মিশে গেছে অবচেতনে। মৃদুলদা আবার লোভ দেখিয়েছে প্রণয়কে রথের মেলায় নিয়ে আসার‌। যাহ্! সকাল বেলা কী সব সাত পাঁচ নিরর্থক ভেবে চলেছে! হাতের কাজ না সারলে রক্ষে থাকবে! মা'য়ের চিৎকারের তীক্ষ্ণতায় গাছের পাখিগুলো পর্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়বে। তখন আর মৌটুসিকে তার মনের কথা বলা হবে না, তাই সে একটু তাড়াতাড়িই কাজে হাত লাগিয়ে ফেলে। দেখা যাক জগন্নাথের কী ইচ্ছে!

      দুপুর থেকেই আবহাওয়া পরিবর্তিত হলো। বৃষ্টি এলো বলে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাসে উৎসবের আমেজ। পাড়াতেও ব্যস্ততা নজরে আসছে। রথের মেলায় যাবে বলে সবাই হয়তো আগে ভাগেই সব গুছিয়ে নিচ্ছে। বাচ্চাদের মধ্যেও পরবের ধুম। রজন্যা শুনতে পাচ্ছে ভাই বোন দুজনেই আবদার জুড়েছে, মেলায় যাবে বলে। 
চুপি চুপি স্টোর রুমের সরু ঘরটায় এসে তক্তপোষর তলা থেকে একটা টিনের বাক্স বের করলো। এই বাক্সটা অষ্টমঙ্গলার পর তার মা বাপের বাড়ি থেকে এনেছিলো। তখনকার দিনের এই বাক্সটা পুরানো, নড়বড়ে হয়ে পড়তেই স্টোর রুমে জায়গা হয়েছিল। এটাই এখন রাজন্যার গোপন আলমারি। এখানে কিছু বাঁচিয়ে রাখা সালোয়ার কামিজ রাখা আছে। সালোয়ার সেট নয়,এর আপার তো ওর লোয়ার। ভালো জিনিস ; সে খাবার হোক বা পরার খুব বেশি বরাদ্দ হয়নি তার জন্য।  যেমন হোক একটা নীল ওড়না আর একটা নীল কালো প্রিন্টের পাটিয়ালা খুঁজে পেলো। এর সাথে ভাঁজ করা একটা সাদা কুর্তি পেয়ে গেলো। ব্যাস এতেই চলে যাবে। আলাদা করে একপাশে সরিয়ে রাখলো, যদি মেলায় যাবার বরাত হয়।

         বিকেল হতেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। আকাশটা গুম হয়ে আছে। এমন সময় মায়ের হাঁক পড়লো- রাজি, শুনে যা-
রাজন্যা সামনে আসতেই মা আদেশ করে রথতলা থেকে পাঁপড়,জিলিপি আনার জন্য। এই খারাপ ওয়েদারে মা ভাইবোনকে নিয়ে রথের মেলায় যাবে না। রাজন্যা মনে মনে এই ফরমায়েশ শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলো বোধহয়। মুখে বললো- ঠিক আছে যাচ্ছি, মেলায় অনেক লোক থাকবে জামাটা পাল্টে আসি। কিছুক্ষণ আগের সরিয়ে রাখা পোশাক পরে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়লো। মা আবার হেঁকে বললো গরম গরম ভাজিয়ে আনবি। এই কথাটা আর কানে ঢোকেনি রাজন্যার। একটা ঘোরের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লো সে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে, ছাতাটাও সাথে নিলো না। গুমোট আকাশের মুখ ভার আজ আর তাকে আটকাতে পারবে না মনে হচ্ছে।

         আটচালার পিছনের রথঘর থেকে রথ বেরিয়ে পড়েছে, ছেলে বুড়োর ঢল নেমেছে রাস্তায়, রথের দড়িতে রাখা হাতগুলো চেনা যাচ্ছে না, কী অপূর্ব সাজানো হয়েছে রথটাকে। হাজার আলোক মালায় মোড়া যেন। শ্রীজগন্নাথ বলভদ্রদেব বোন সুভদ্রাকে নিয়ে এগিয়ে আসছেন, দেখে নয়নযুগল সার্থক হলো। রথের উপরে সাদা পাটের ধুতি পরিহিত বেশ কয়েকজন পুরোহিত পুজোর মন্ত্র বলে ভক্তদের ফুল বিতরণ করছেন। আকাশের গুমোট ভাব কখন কেটে গিয়ে নীল সাদার হাসি উদ্ভাসিত। বিভোর হয়ে রাজন্যা জগন্নাথের শোভাযাত্রা দেখছে, এমন সময় একটা দৃঢ় হাত তার বাম হাত চেপে খানিকটা সরিয়ে নিয়ে নাটমন্দিরের চাতালে নিয়ে এসে থামলো। জগন্নাথের রথ থেকে চোখ সরিয়ে বামদিকে তাকাতেই প্রণয়কে দেখতে পেলো রাজন্যা।

                        এরপর আগামী সপ্তাহে.....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ