ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি -পর্ব-০৫/ রঙ্গনা পাল
আবারো বৃষ্টি শুরু। রাজন্যা, প্রণয় দুজনেই উঠে এলো নাটমন্দিরের উপরে। রাধা দামোদরের যুগলমূর্তি ছাড়া মন্দিরের আশেপাশে জনপ্রাণী নেই, সকলেই রথযাত্রায় সামিল হয়েছে হয়তো। বৃষ্টির শব্দ ক্রমে রাজন্যার বুকে হাতুড়ি পিটছে যেন, বুঝতে পারছে না, দৌড়ে বেরিয়ে যাবে নাকি প্রণয়ের সাথে কিছু কথা বলে হৃদয়ের সাইক্লোনকে থামাবে। নাহ্ পা দুটো বেইমানি করছে, দৌড়ানো তো দূর একটা কদমও এগোচ্ছে না, স্বপ্নে ভূত দেখে চিৎকার করতে গেলে যেমন দম আটকে যায় তেমনি শ্বাসবায়ু আটকে গিয়ে কথা বেরোচ্ছে না মোটে। কী করবে বুঝতে পারছে না! প্রণয় রাজন্যার মনের অবস্থা অনুমান করে পরিস্থিতি নরম করার জন্যই বলল-
- তুমি আসবে আমি ভাবতে পারিনি- জানো, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে আজ..
রাজন্যার বলতে ইচ্ছে করছিলো তোমার জন্যই আজ নিজেকে সামান্য হলেও গুছিয়ে এসেছি। সেসব বলা হলো না, আমতা আমতা করে বললো...
- না মানে, ভাইবোনদের জন্য জিলিপি পাঁপড় কিনতে এসেছি।
-কারণ যাই হোক, এসেছো এটাই বড়ো কথা, মৃদুল বলেছিল তুমি আসবে।
-আমি আসবো এমন কথা দিইনি, আসতে পারবো এমন নিশ্চয়তা ছিলো না।
- তবু তুমি এসেছো, আমি খুব খুব খুশি।
-আমারও আপনার সাথে দেখা হয়ে ভীষণ ভালো লাগছে।
-আর আমাকে ভালো লাগছে না?
-হুঁ....
-চলো ওখানে গিয়ে একটু বসি
- বাড়ি যেতে হবে, সন্ধে হয়ে গেছে। দেরি করলে মা বকাঝকা করবেন।
আরে এসো তো- আজ তোমাকে আমার মনের কথা বলবো, আমি তোমায়....
কথা শেষ হলো না, হবে হয়তো। বেশ অপেক্ষা করবে না হয়। কথা চলতে চলতেই নাটমন্দিরের একটা কোণে দুজনে মুখোমুখি বসে পড়লো। রাজন্যা ভাবছে হয়তো প্রণয় আজ তার ভালোবাসার কথা বলবে, যেটা শোনার জন্য একবছর ধরে সে অপেক্ষা করছে। আবার প্রণয় ভাবছে মনের কথা বলার মতো এমন সুযোগ আর পাবে না, রাজন্যার হাতদুটো ধরেও ফেললো তার মনের কথা বলার জন্য কিন্তু পারছে না..... বলি বলি করেও বলতে পারছে না ভালোবাসি, ভালোবাসি। রাজন্যার সারা শরীর শিরশির করছে, তবু হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে না। ওদিকে রাজন্যা মৃদুলদাকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো। এখন তো আর দেখছে না, কোথায় গেলো তাহলে! প্রণয়কে দেখে সুবিধের ঠেকছে না, চারপাশে কেউ নেই। ভালোবাসার কথা বলার পরিবর্তে যদি অপমানজনক কিছু বলে বসে! নিজের ভাগ্যটাকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। ভালো কিছু তো ঘটে না, উল্টে খারাপটাই তার নসীব হয়। আবার এটাও ভাববার ভালোবাসার কথা না হলে এমন হাত ধরে আছে কেন! নাটমন্দিরের পিছনের ফাঁকা জায়গাটা থেকে শিয়াল ডাকলো মনে হচ্ছে। ভয়ে বুকটা কাঁপছে। বাড়ি যেতে দেরি হয়ে গেলে ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে। দূর..ভালো লাগছে না। আর...একদিকে প্রণয়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই, অন্যদিকে বাড়ি ফেরার টান।
প্রণয় একবার চারপাশটা বেশ ভালো করে দেখে নিলো। নাটমন্দির মৃদু আলোতে মায়াবিনী লাগছে রাজন্যাকে। মুখে কোন কথা বলতে না পেরে রাজন্যাকে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিলো। রাজন্যার বুকের উপত্যকায় সজোরে ধাক্কা খেলো একবার, তারপর ডুব দিলো অথৈ সাগরে। ভেসে যাচ্ছে আবেগে, ভালোবাসায়। রাজন্যা তার ভালোবাসার মানুষটির পাগলামিতে হঠাৎ মনে মনে হেসে ফেললো। হ্যাঁ, প্রণয়কে খুব ভালোবাসে রাজন্যা। এতদিন চোখে হারিয়েছে। আজ চোখের সামনে পেয়ে হারাতে চাইছে না, কিন্তু প্রণয় এটা কী করছে ! এটা কী ভালোবাসা , নাকি তাকে জড়িয়ে ধরার ছল! কে জানে! তবু খারাপ তো লাগছে না, তাহলে কি রাজন্যাও এটা চেয়ে এসেছে! ভাগ্যিস মৃদুলদা ধারে পাশে নেই ! অন্য কেউ দেখে ফেললো না তো! বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলে তার মা সটান বাড়ি থেকে বের করে দেবে, তখন কোথায় যাবে সে? অগত্যা আরো কিছু ঘটে যাওয়ার আগে রাজন্যা একপ্রকার জোর করেই ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। ঠিক সেসময়ই মৃদুলদাকে মন্দিরের গাঁ ঘেঁষে মালা হাতে এগিয়ে আসতে দেখলো। জুঁই ফুলের মালা! হঠাৎ কিছুটা দূর থেকেই মৃদুলদা ছুড়ে দিল মালাটা। মাটিতে, গলায়, দুজনের মাঝখানে বা নাটমন্দিরের মেঝেতে মালাটা পড়ার আগেই রাজন্যা মালাটাকে হাত বাড়িয়ে লুফে নিলো। জুঁই তার দারুণ পছন্দের, মৃদুলদা জানলো কি করে! গন্ধটা প্রাণ উপভোগ করার আগেই, রাজন্যার বামগালে প্রণয়ের ডানবাহুর সজোর থাপ্পড় এসে পড়লো। মৃদুলদা ততক্ষণে ধরে না ফেললে রাজন্যা হয়তো চড়ের টাল সামলাতে পারতো না।
প্রণয় আর দাঁড়ায়নি। মুহূর্তের মধ্যেই রাজন্যাকে ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। বলা হলো না কিছুই। তবে প্রণয় বুঝে গেছে রাজন্যা তাকে ভালোবাসে না, যদি বাসতো তাহলে ওভাবে তাকে অবজ্ঞা করতো না, তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মৃদুলের দেওয়া মালাটা হাতে নিতে পারতো না। সে হয়তো মৃদুলকেই ভালোবাসে। চড় মারাটাও ঠিক হলো না, তার কী অধিকার আছে রাজন্যাকে চড় মারার! একটা কথা সে ভেবে পাচ্ছে না, যদি মৃদুলকেই সে ভালোবাসে তাহলে তাকে কেন বললো না! না, আর নয় ভালোবাসার জন্য অনেক সময় অপচয় হয়েছে, এবার পড়াশোনায় মন দিতে হবে। আর কখনো রাজন্যার কথা সে ভাববে না। সেদিন বৃষ্টির মরশুমে সেই প্রথম কোন নারীকে চুম্বন করেছিলো। হয়তো এত সহজে এটা ভুলতে পারবে না, তবু চেষ্টা করতে হবে। কেনই বা সেই নারীকে নিয়ে মুহুর্তগুলো নষ্ট করবে যে তাকে ভালোই বাসে না।
এরপর আগামী সপ্তাহে.....

0 মন্তব্যসমূহ