ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি / রঙ্গনা পাল / পর্ব-৭
ইস্! প্রায় রাত হয়ে এল। মা একেবারে মুখিয়ে ছিল, বাড়িতে পা রাখা মাত্র মা'র কোপে পড়তে হল রাজন্যাকে। কি ব্যাপার রে? মেলায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি? সত্যিই তো! রীতিমতো দেরি করে ফিরেছে সে। অতএব সহ্য করা ছাড়া আর কি বা করার থাকতে পারে! রাজন্যাকে অবাক করে দিয়ে একেবার তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে মা হঠাৎ বলে- "ওগুলো তুই খেয়ে নে, আমাদের আর লাগবে না..." এ আরেক ঝামেলা মূর্তিমান হলো! কী করবে সে এখন তাহলে! হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে বলে ফেলল "প্রচুর ভিড় ছিল রাস্তায় আবার জিলিপি পাঁপড়ের দোকানেও লম্বা লাইন..." তাছাড়া...
-তাছাড়া কি মুখপুড়ি?
-না, তেমন কিছু না-
-আবার কাব্য হচ্ছে? বল কী হয়েছিল?
-মানে থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ার কথা বলছিলাম।
মা এবার রাজন্যার হাত থেকে প্যাকেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন। রাজন্যার স্বগতোক্তি- "যাক্ বাবা এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম" বলেই আর না দাঁড়িয়ে একেবারে নিজের একান্ত আপন সুখ দুঃখের স্টোররুমে এসে পৌঁছল। এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে খানিক বসার জন্য হাঁটু ভাঁজ করতে যাবে আবার মায়ের হাঁকডাক- রাজি, এই রা জি....
আর সাড়া না দিয়ে একেবারে মায়ের সামনে এসে হাজির হলো রাজন্যা। মায়ের প্রশ্ন-
- এতগুলো জিলিপি পাঁপড় কোত্থেকে আনলি? এত টাকা তো আমি দিইনি-
-সে তো বলতে পারব না...
-তাহলে এগুলো হাওয়া থেকে টপকালো নাকি রে? বল বাড়তি টাকা তুই কোথা থেকে পেলি?
-যা পেয়েছি তা নিয়ে এসেছি।
চুপ করে গেল রাজন্যা। উফ্! ভিতরটা ফালা ফালা হয়ে গেছে, সামান্য দাঁড়িয়ে থাকার বলটুকু পর্যন্ত নেই! যে কোন মুহূর্তে উল্টে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল । হে ঈশ্বর! আর কতো? মাথার শিরাগুলো পর্যন্ত ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। এটুকু বুঝেছে যা গেছে হয়তো তা ফিরবে না কখনো, তার স্বপ্নের রাজপুত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মন খারাপের জঙ্গলে। জানে না সেই গভীর মনখারাপের জঙ্গল ভেদ করে আর কোনদিন তার দেখা পাবে কিনা!
রাজন্যাকে চুপ করে থাকতে দেখে মা আর কথা বাড়ালো না। ভাবলো হয়তো দোকানদার-ই ভুল করে বেশি দিয়ে ফেলেছে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে পুনরায় ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। যাবার সময় বলে গেলো, "সঙের মতো এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যা গিয়ে নিজের কাজ কর"। আবারো চলে গেলো মা। জিলিপি পাঁপড় অতিরিক্ত এসেছে তবু তার ভাগ্যে কিছুই জুটলো না, যদিও খিদে তৃষ্ণার কথা চাপা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই । খাবার নয় তার মায়ের কোপ থেকেই মুক্তি পাবার অপেক্ষাতেই ছিল রাজন্যা। নিজের জায়গায় ফিরে এসে ধপ করে বসে পড়ে তক্তাটায়। বিনা দোষের সাজায় বড় বেশি আহত হয়েছে সে। মানছে, তার জন্মটা বাবা মা'র অভিপ্রেত নয় তাই বলে কি এতটুকু আলোর দিশা থাকবে না তার জন্য? এক নক্ষত্রই তো সমগ্র জগৎকে আলোকিত করে তবে কেন সে বারে বারে অন্ধকারে ডুবে যায়? এখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সে বাঁচবে কেমন করে! পা দুটোকে শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে এল সেই দক্ষিণের জানলার কাছে, জানলাটা খোলা আছে। তাকিয়ে দেখলো আঁধারে ডুবে আছে সমস্ত কিছুই, আলো পেতে শুধু একটা ভোরের জন্য অপেক্ষা করছে তারা....সেও আঁধারে পেলো রবির দিশা। গেয়ে উঠলো-
"আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা--
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়...."
সময়ের হাত ধরে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে পার করে মাধ্যমিকে যথেষ্ট ভালো ফল করলো রাজন্যা শুধুমাত্র তার ঐকান্তিকতার জন্য, অধ্যবসায়ের জন্য, কঠিন পরিশ্রমের জন্য। সেবাকে ধর্ম করে নিজের পথ নিজেই ঠিক করে নিল সে। নার্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাড়ি দিলো। নতুন পরিবেশে নতুন জীবন যাপনের মুহূর্তগুলো তার কাছে ভীষণ সুখকর হয়ে উঠল। এ একরকম প্রাকৃতিক নিয়মেই জীর্ণ পাতা ঝরে গিয়ে কিশলয়ের সমাগম হওয়া। এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে প্রাণভরে। এছাড়াও বদ্ধ জলাশয় মতো সেও যেন বর্ষার প্লাবনে নদীর সাথে মেশার সুযোগ পেয়ে গেলো। এবার শুরু মোহনার গাওয়া।
মেডিক্যাল কলেজেই রাজন্যার সাথে একদিন দেখা হয়ে গেলো স্বরাজের সাথে। স্বরাজ হালদার। পড়াশোনায় ভালো বলে আর পাড়ার আমুদে বড়লোক বলে স্বরাজদের খুব নাম ডাক। পাড়ার লোক তাদের বাড়িটাকে হালদার ভবন বলেই চেনে। ওরা তিন ভাই স্বরাজ,পৃথ্বীরাজ, যুবরাজ । এরা প্রত্যেকেই এক একটি রত্ন। রাজন্যা ভুলেও কখনো তাদের চারপাশ মাড়ায়নি, কিন্তু আজ মুখোমুখি দেখা হওয়ায় একেবারেই কিছু না জিজ্ঞেস করে পারল না। স্বরাজের মুখ দেখে মনে হলো সেও রীতিমতো অবাক হয়েছে তাকে এখানে দেখে। শুধু উন্নাসিকতার জন্য কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। রাজন্যাই প্রথম কথা বলে-
-এখানে হঠাৎ?
--মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে ডঃ রানার সাথে একটু দেখা করবো।
-ও আচ্ছা সোজা গিয়ে ডানদিকে ওঁর চেম্বার, তুমি নিশ্চয়ই জানো-
-হ্যাঁ জানি। কিন্তু তুমি এখানে কবে থেকে?
-সম্প্রতি...
আর কথা না বাড়িয়ে চলেই যাচ্ছিল রাজন্যা স্বরাজ পিছু ডেকে বলে-
-মা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চান, অবশ্য কথাটা আমারও..
আচমকা এই কথাটায় ঘাবড়ে গেলেও, অযথা বিশেষ কৌতূহলী না হয়ে নিজেকে সামলে সাধারণভাবেই জিজ্ঞেস করলো-
-কী বলতো?
-এখন না, পরে বলব। মা একটু সুস্থ হয়ে যাক্ তারপর আমি মায়ের কাছে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি যদি তোমার বর্তমান ঠিকানাটা দাও খুব ভালো হয়।
ঠিকানাটা বলেই রাজন্যা নিজের জায়গায় ফিরে এলো।
নতুন করে ভাবনার বুনন শুরু হলো রাজন্যার। অনেকগুলো প্রশ্ন তার চিত্তচাঞ্চল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে কেবল। মন-সাগরের উত্তাল ঢেউগুলো এসে তাকে বারেবারেই বেসামাল করে দিচ্ছে।
- এরপর আগামী সপ্তাহে......

0 মন্তব্যসমূহ