Header Ads Widget

বিশ্ব বঙ্গীয় সাহিত্য কলা আকাদেমি (Reg No:1900200271/2023)

ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি , রঙ্গনা পাল ,পর্ব-৫০ (অন্তিম পর্ব)

ঝড়ের পাখি  , রঙ্গনা পাল  ,পর্ব-৫০ (অন্তিম পর্ব)

        প্রায় বার্ধক্যে এসে পড়েছে রাজন্যা। রিটায়ার হবে সামনের বছরে। রাজর্ষি এখন স্বাবলম্বী। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নামী কোম্পানিতে কর্মরত। ছেলে তার হীরের টুকরো। চেষ্টা করেও স্বামীর সাথে ঘর বাঁধতে পারেনি, আজ তার ছেলে তাকে তার ঘরে দেবী করে রেখেছে। মায়ের সুখ দুঃখের সাথি হয়ে ভুলিয়ে দিয়েছে শতেক যন্ত্রণা। মনের রোগ, স্বাধীনের প্রতি বিরূপ মনোভাব, বাবা-মার প্রতি ক্ষোভ, শ্বশুরবাড়ির প্রতি বিদ্বেষ ভুলিয়ে আজ রাজর্ষি রাজন্যার মতো ঝড়ের পাখির জন্য নিপুণ নীড় তৈরি করে দিয়েছে। আরাধ্য দেবদেবী, আনন্দের প্যাভলভ আর স্নেহের রাজর্ষিকে নিয়ে ভালো আছে রাজন্যা।


          গান ছিলো রাজন্যার প্রাণ, অনেকদিন আগেই নির্মম পরিস্থিতি তার কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নিয়েছিল। ছেলের মধুর কণ্ঠে সেই গান শুনে মনটা খুশিতে ভরে যায়। একবার তার জন্মদিনে রাজর্ষি তাকে উপহার দিয়েছে একখানা পোট্রেট, যাতে সে তার মাকে সুন্দর ভাবে এঁকেছে। আনন্দে চোখ দিয়ে জল এসে গিয়েছিলো। ওকে আঁকা শেখানো হয়নি, গানও শেখানো হয়নি তবু দুটো বিভাগে সমান পারদর্শী হলো কীভাবে ভেবে পায় না! অজান্তেই দুটো হাত জড়ো করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। সত্যি এতো ভালোবাসা ছিলো তার বরাতে! ছেলেটাকে বিশেষভাবে নজর দিতে পারেনি বলে রাজন্যার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করতো। এতবার ভাঙতে ভাঙতে শির সোজা করে পথ চলতেই বহু বছর কেটে গেছে। তবু, ছেলের শ্রদ্ধা হারায়নি এটা ভেবে প্রীত বোধ করছে। ছেলে তাকে চোখের মণি করে রেখেছে। এখন গর্ব বোধ হয় এমন একটা ছেলের মা হতে পেরেছে বলে। 


        রাজন্যা মনে মনে চিন্তা করে এবার ছেলের বিয়ের তোড়জোড় করতে হবে। ছেলে পাত্রী পছন্দ করে রেখেছে। অবশ্য একটা ভুল থেকে যাচ্ছে। পাত্রীই ছেলে পছন্দ করেছে। রাজর্ষি এ ব্যাপারে একেবারেই অপটু। মায়ের জীবনের টানাপোড়েন আজও ভুলতে পারে না সে। ভয় হয়, খুব ভয় হয়। তাই কোন মেয়ের পাশে ঘেঁষে না পর্যন্ত। বিদ্যা আগরওয়াল নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার। স্যোশাল মিডিয়ায় আলাপ। আকাশের কভারের স্কেচটা দেখে আকাশের প্রোফাইল ফলো করেছিলো বিদ্যা। তারপর ফ্রেন্ড  রিকোয়েস্ট পাঠায়। আকাশ অ্যাকসেপ্ট করে নেয়। আকাশ আসলে রাজর্ষির মায়ের দেওয়া আদরের নাম। রাজন্যা মনে করে তার ছেলেই তার আকাশ।


           পরিচয় যত এগিয়েছে, বিদ্যা দেখেছে রাজর্ষির সৌন্দর্য তো বটেই ওর বিনয়, সংযম আর পরিমিতিবোধ আজকের ছেলে ছোকরাদের চেয়ে একদম আলাদা। রাজর্ষির দরাজ কণ্ঠ আর আঁকার প্রতি নিষ্ঠা তো ছিলোই। সবে মিলে বিদ্যা আকাশকে ভালোবেসে ফেলেছে। আকাশের আসল নাম জানার পরেও বিদ্যা রাজর্ষিকে আকাশ বলেই ডাকে। রাজর্ষি প্রথমটায় রাজি হয়নি, বিদ্যাকে রাজন্যার সাহায্য নিতে হয়েছে‌। রাজন্যা ছেলেকে বুঝিয়েছে, "ও ভালো মেয়ে, ওকে না করিস না। তোকে খুব ভালো রাখবে দেখিস"। বিদ্যার মিষ্টতা ভালো লেগেছে রাজন্যার। বিদ্যার পরিবার বাঙালি পরিবারে সম্বন্ধ করতে নিমরাজি থাকলেও এখন রাজর্ষি, রাজন্যার সাথে আলাপ করার পর বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। রাজর্ষি বিদ্যার কাছে তাদের মা ছেলের পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে, কিছুমাত্র গোপন করেনি। বর্তমানে রাজর্ষির বাবার সাথে তার মা ঘর না করলেও যদি কখনও তার বাবা আসে তাহলে তার সাথে অতিথি সুলভ আচরণ করা হয়, এই কথাটাও বিদ্যা জানে। সব জেনেই বিদ্যা আকাশের হতে চেয়েছে।


          ছেলের বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে রাজন্যা তার স্বপ্ন পূরণের দিকে এগোবে। আর একটা বছর মাত্র, তারপর তাকে প্যাভলভ ছাড়তে হবে। ওখানকার অনাথ মানসিক রোগীদের জন্য তার প্রাণ কাঁদে। সুস্থ হয়ে যাবার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের কেউ ফিরিয়ে নিতে আসে না। ওদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখেছে রাজন্যা। শিশির, শ্রেষ্ঠারাও আস্বস্ত করেছে তারা রাজন্যার পাশে থাকবে। অনাথ আতুরদের জন্য একটা ঠিকানা রাখবে। নাম দেবে 'রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশন ' । অবসরের পর 'রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশন' হবে রাজন্যার বেঁচে থাকার রসদ। যাদের কেউ নেই রাজন্যা তাদের সকলের দায়িত্ব নেবে। ছেলেকে তার স্বপ্নের ঠিকানার কথা জানালে ছেলে বলেছে, "আমি তোমার সাথে থাকবো মা, তোমার স্বপ্নপূরণের অংশীদার হবো"। মানবাধিকার কমিশনের সদস্যপদ নিয়ে ফেলেছে রাজন্যা। এবার শুধু লক্ষ্যে এগোনোর পালা।


        একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঠাকুরগাঁও-এ পাঁচবিঘে জমির ওপর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হলো। কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। দ্রুত গতিতে কাজ এগোচ্ছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছেলে, বৌমা, প্রতিবেশী প্রত্যেকেই। অনুদানও পাচ্ছে ঢালাও। সকলের সহযোগিতায় গড়ে উঠলো 'রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশন'। রাজন্যার মহৎ উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ রূপ পেলো। স্বপ্নের মহল গড়ে উঠলো। রিটায়ার্ড হওয়ার পর রাজন্যার সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে ঢেলে সাজানো হলো এই ফাউন্ডেশনকে। প্রচুর গাছ লাগিয়েছে সকলে মিলে, এখন শুধু প্রতীক্ষা কবে পল্লবে পল্লবে সেজে উঠবে এই প্রতিষ্ঠান। 


          মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচ বৃষ্টির ঝাঁটে ঝাপসা হয়ে এলো। হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে, খেয়াল করেনি। বৌমা এসে দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করতে এলে, বাধা দিলো রাজন্যা। বিদ্যা বোঝে শাশুড়িমা হয়তো কোন স্মৃতির খোঁজে নস্টালজিক হয়ে আছেন, তাই নিঃশব্দে সে ওই ঘর থেকে চলে এলো। ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে, তার স্বপ্নের শৌধ তৈরি হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে ওখানে আসার ব্যাপারে বেশকিছুজন তার সাথে যোগাযোগ করেছে। এবার ভালো একটা দিন দেখে উদ্বোধন পর্ব সারলেই একাকিত্ব দূর করতে পারবে। আজ তো রাজন্যার পরিপূর্ণ সুখের দিন, তবু ভেতরে একটা ঝড় উঠেছে মনে হচ্ছে। এই ঝড়টা কিসের জন্য? তবে কী স্বাধীনের জন্য কোথাও একটা জায়গা রয়ে গেছে? অনেকক্ষণ পর চশমার কাঁচ মুছে নিয়ে দেখলো তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতির কাছে এবার নিজেকে সমর্পণ করে গেয়ে উঠলো...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ