ঘর বেঁধেছে ঝড়ের পাখি/ রঙ্গনা পাল/ পর্ব ৪৮
-বৌমা...
এত নরম আর এত আবেগ মাখানো গলা শুনে বেশ খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লো রাজন্যা। মনটা কেবলই কু গাইছে..তবু উদ্বেগ চাপা দিয়ে সে সাড়া দিল-
-হ্যাঁ মা বলুন..
-আমার ছেলেটা থেকে আমাকে আলাদা করে দিলে?
-মানে?
আজ বছর খানেক ধরে ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখতে দিচ্ছো না...!
ন্যাকামোপনার একটা মাত্রা থাকে, সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে শাশুড়ির কথাগুলো তীরের ফলার মতোই ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে রাজন্যাকে! শাশুড়ি বলে কী! সে তার ছেলেকে মায়ের থেকে আলাদা করে রেখেছে? বছর যাবৎ দেখা করতে দিচ্ছে না? এত্তো ক্ষমতা? যত্তসব...দাঁতে দাঁত চেপে রেখে রাজন্যার সংযত উত্তর-
-কী যা তা বলছেন..
-দাও না মা, একবার আমার ছেলেটার সাথে দেখা করিয়ে..
এবার রাজন্যার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। প্রতিবাদের সুর গলায় ঢেলে সোজাসুজি বলে উঠল..
-আমাকে আপনি ভালো থাকতে না দেওয়ায় দিব্যি কেটে এসেছেন বুঝি?
-বাড়ি বয়ে এসেছি তাই বিষোদ্গার করছো?
-সে তো আপনি আমার উপর এতকাল করে এসেছেন! এ কাজ কেবলমাত্র আপনার, আমার নয়। এটা বোধহয় আপনি আমার থেকে আরও ভালো জানেন।
-না, না বৌমা...বছর খানেক আগে কলকাতার ফ্ল্যাটের দখল ছাড়ার দস্তখত করার পর ওকে না তো ফোনে ধরতে পারছি আর না কোন খোঁজ পাচ্ছি।
-এতদিনে তাহলে ছেলে তার মাকে সঠিকভাবে চিনেছে। বড় ছেলেকে কীভাবে সকল সম্পত্তি, বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট থেকে উৎখাত করে বাকি ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন! সত্যি আদর্শ মা আপনি! আমি তো লোকের মুখে শুনে এর সত্যতা পর্যন্ত যাচাই করতে যাইনি, তাহলে আজ কেন আমায় এসবের মধ্যে জড়াচ্ছেন?
-তুমি আমার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো..
-দুঃখিত, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না, এবার আমায় একটু বেরোতে হবে, আমি উঠলাম। আপনি সাতসকালে এসেছেন চা জলখাবার খেয়ে যাবেন।
কোন কাজ না থাকলেও শাশুড়ির ফালতু বকবক সহ্য করতে না পেরে বাজারের থলি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রাজন্যা। তবে এটা শুনে ভারি আশ্চর্য লাগলো যে, স্বাধীন তার মা'র সাথে এখন যোগাযোগ রাখে না। শাশুড়ি তাকে কখনোই ভালো বাসেনি ঠিক, তবে সে কখনও শাশুড়িকে কথা শোনাবে এটা কল্পনাতেও আসেনি। আজ অনভিপ্রেত এই ঘটনার জন্য খারাপ লাগছে। পাছে বেশিকিছু বলে ফেলে, তাই ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। নিজের নিজের কর্মফল ভোগের সময় এসেছে হয়তো। স্বাধীন কোন কথা রাজন্যাকে বলে না, প্রয়োজন বোধ করে না। বিয়ের পর থেকে সুস্থ এবং শান্তিপূর্ণ দিন কাটিয়েছে এমনটা মনে করতেই পারে না। স্বাধীনের স্বেচ্ছাচারিতার সাথে তার মায়ের উস্কানি প্রতিটি পদক্ষেপে যে বাধার পাহাড় সৃষ্টি করেছে, সেটা টপকে সুখ খুঁজতে যাওয়ার বিলাসিতায় রাজন্যা গা ভাসানোর চেষ্টাও করেনি বরং পরিস্থিতির সাথে নিজেকে সামলে রেখেছে। আজ অন্তত এসব সংসার, আত্মীয়তা, সম্পত্তির জন্য পাগলামি তার নেই। প্যাভলভের মনোরম পরিবেশে এখন সে স্বস্তির শ্বাস নিতে পারছে।
এখানকার গাছগাছালি, শান্ত আবহাওয়া, জায়গায় জায়গায় অকৃত্রিম ভালো থাকার পরিবেশ, সর্বোপরি এখানকার আত্মভোলা পাগল মানুষগুলোর মধ্যে যে প্রাণ, বন্ধন এবং আত্মীয়তা রাজন্যা খুঁজে পেয়েছে তা তথাকথিত ভদ্র সমাজের মানুষগুলো থেকে পায়নি। স্বাধীন এখন তার সাথে থাকে না বলে আক্ষেপ নেই। সে কোথায় থাকে জানে না, জানার চেষ্টাও করেনি। মাঝেমধ্যে কখনও সখনও আসে বা ফোনে খোঁজ নেয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ করা বা কোন দায়িত্ব চাপানোর প্রয়াস করেনি। নিজের মতো ভালো থাকায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ শাশুড়ি আসায় অতীতের স্মৃতি মনের আয়নায় দেখতে পাচ্ছে। মনে করতে না চাইলেও বিক্ষিপ্তভাবে বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলো ভেসে উঠছে। বাইরে বাইরে ঘুরতে ভালো লাগছে না, টুকটাক বাজার করে বাসায় ফিরে এলো রাজন্যা। রেণুকা এসে জানালো-রাজন্যা বেরোবার পরই উনি বেরিয়ে পড়েছেন, তার বানানো জলখাবার না খেয়েই। রাজর্ষি যথেষ্ট বড় হয়েছে কিন্তু ঠাম্মির প্রতি ভীতি এখনও কাটেনি। সহজভাবে কথা বলতে পারে না। আর ঠাম্মিও রাজর্ষির প্রতি কোন আগ্রহ প্রকাশ করে গেলেন না। আজব মানুষ সব।
বেলা গড়িয়ে দুপুর তবু সকালের গুমোট থেকে গেছে। যে যার ভাবনায় ব্যস্ত। অন্য দিন একে অপরের সাথে বাক্-বিনিময়ে দিন যাপন করে। আজকের ছুটির আকাশটা কেমন অসময়ের মেঘের মতো কালো হয়ে এলো। এভাবে চলতে থাকলে কেউ ভালো থাকবে না তাই রাজন্যা নিস্তব্ধতা ভেঙে রাজর্ষিকে বলে চল আজ বিকেলে কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি, রাত্রে ডিনার সেরে ফিরবো। রাজর্ষি তো এককথায় রাজি। রাজর্ষির গম্ভীর মুখে হাসির উদ্রেক হলো। পরিকল্পনা ব্যর্থ করে আরও চমক তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো এটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। রাজর্ষিরা বের হওয়ার আগেই স্বাধীন এলো। একইদিনে ঠাম্মি আর বাবাকে আসতে দেখে রাজর্ষির মনে হাজার প্রশ্নের ঝড় ওঠে। রাজন্যাও হতচকিত। প্রশ্ন করে বসলো-
-একইদিনে হঠাৎ মা ছেলের আগমন-
-মা এসেছিলো নাকি? কখন?
-সকালবেলায়।
-কেনো এসেছিলো এখানে?
-সে তো তোমার জানার কথা।
চুপ করে যায় স্বাধীন। মায়ের ব্যাপারে রাজন্যাকে কোন কথা বলতে চায় না সে। কিন্তু মা ঠিক কী কী বলে গেছে আন্দাজে ঠাহর করতে পারছে না। আবার সাহস করে জিজ্ঞেস করতেও পারছে না। সে এখানে এসেছিলো একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। এখন কীভাবে সেটা উত্থাপন করবে ভেবে পাচ্ছে না। স্বাধীনকে চুপ থাকতে দেখে রাজন্যা বলে-
-কী হলো? কোন উত্তর নেই যে..
-আমি ঠিক জানি না...মায়ের সাথে আমার কথা হয় না..তোমায় কী বলে গেলো?
-আমার খবর নিতে এসেছিলো। তুমিও হয়তো সেটাই নিতে এসেছো নিশ্চয়ই..
রাজন্যার কথায় উষ্মা ছিলো। গায়ে মাখলো না স্বাধীন। কীভাবে নিজের কথা বলবে মনে মনে সেটাই আওড়ে চলেছে..
-এরপর আগামী সপ্তাহে....
-

0 মন্তব্যসমূহ